পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৮২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

জলচর পাখি । সেখানে যে-সব ছোটো গল্প লিখেছি তার মধ্যে আছে পদ্মাতীরের আভাস । সাজাদপুরে যখন আসন্তুম চোখে পড়ত গ্রাম্যজীবনের চিত্র, পল্লীর বিচিত্র কর্মোদাম । তারই প্ৰকাশ * পোস্টমাস্টার’ ‘সমাপ্তি ‘ছুটি” প্রভৃতি গল্পে । তাতে লোকালয়ের খণ্ড খণ্ড চলতি দৃশ্যগুলি কল্পনার দ্বারা ভরাট করা হয়েছে। সেই সময়কার একদিনের কথা মনে আছে । ছোটাে শুকনো পুরানো খালে জল এসেছে । পাকের মধ্যে ডিঙিগুলো ছিল অর্ধেক ডোবানো, জল আসতে তাদের ভাসিয়ে তোলা হল । ছেলেগুলো নতুন জলধারার ডাক শুনে মেতে উঠেছে । তারা দিনের মধ্যে দশবার করে বঁাপিয়ে পড়ছে জলে । দোতলার জানলায় দাড়িয়ে সেদিন দেখছিলুম সামনের আকাশে নববর্ষার জলভারনত মেঘ, নীচে ছেলেদের মধ্যে দিয়ে প্রাণের তরঙ্গিত কল্লোল । আমার মন সহসা আপন খোলা দুয়ার দিয়ে বেরিয়ে গেল বাইরে । সুদূরে । অত্যন্ত নিবিড়ভাবে আমার অস্তরে একটা অনুভূতি এল ; সামনে দেখতে পেলুম নিত্যকালব্যাপী একটি সর্বানুভূতির অনবচ্ছিন্ন ধারা, নানা প্ৰাণের বিচিত্ৰ লীলাকে মিলিয়ে নিয়ে একটি অখণ্ড লীলা । নিজের জীবনে যা বোধ করছি, যা ভোগ করছি, চার দিকে ঘরে ঘরে জনে জনে মুহুর্তে মুহুর্তে যা-কিছু উপলব্ধি চলেছে, সমস্ত এক হয়েছে একটি বিরাট অভিজ্ঞতার মধ্যে । অভিনয় চলেছে নানা নাটকে নিয়ে, সুখদুঃখের নানা খণ্ড প্ৰকাশ চলছে তাদের প্রত্যেকের স্বতন্ত্র জীবনযাত্রায়, কিন্তু সমস্তটার ভিতর দিয়ে একটা নাট্যরস প্রকাশ পাচ্ছে এক পরমদ্রষ্টার মধ্যে যিনি সর্বানুভুঃ। এতকাল নিজের জীবনে সুখদুঃখের যে-সব অনুভূতি একান্তভাবে আমাকে বিচলিত করেছে, তাকে দেখতে পেলুম দ্রষ্টারূপে এক নিত্য সাক্ষীর পাশে দাড়িয়ে । এমনি করে আপনা থেকে বিবিক্তি হয়ে সমগ্রের মধ্যে খণ্ডকে স্থাপন করবামাত্র নিজের অস্তিত্বের ভার লাঘব হয়ে গেল । তখন জীবনলীলাকে রসরাপে দেখা গেল কোনো রসিকের সঙ্গে এক হয়ে । আমার সেদিনকার এই বোধটি নিজের কাছে গভীরভাবে আশ্চর্য হয়ে ঠেকাল । একটা মুক্তির আনন্দ পেলুম । মানের ঘরে যাবার পথে একবার জানলার কাছে দাড়িয়েছিলুম ক্ষণকাল অবসরযাপনের কৌতুকে । সেই ক্ষণকাল এক মুহুর্তে আমার সামনে বৃহৎ হয়ে উঠল । চােখ দিয়ে জল পড়ছে তখন ; ইচ্ছে করছে, সম্পূৰ্ণ আত্মনিবেদন করে ভূমিষ্ঠ হয়ে প্ৰণাম করি কাউকে । কে সেই আমার পরম অস্তরঙ্গ সঙ্গী যিনি আমার সমস্ত ক্ষণিককে গ্ৰহণ করছেন তার নিতো । তখনই মনে হল, আমার এক দিক থেকে বেরিয়ে এসে আর-এক দিকের পরিচয় পাওয়া গেল ; এষোহস্য পরম আনন্দঃ । আমার মধ্যে এ এবং সে- এই এ যখন সেই সে-র দিকে এসে দাড়ায় তখন তার আনন্দ । সেদিন হঠাৎ অত্যন্ত নিকটে জেনেছিলুম, আপনি সত্তার মধ্যে দুটি উপলব্ধির দিক আছে। এক, যাকে বলি, আমি ; আর তারই সঙ্গে জড়িয়ে মিশিয়ে যা-কিছু, যেমন আমার সংসার, আমার দেশ, আমার ধনজনমান, এই যা-কিছু নিয়ে মারামারি কাটাকাটি ভাবনা-চিন্তা । কিন্তু, পরমপুরুষ আছেন সেই-সমস্তকে অধিকার করে এবং অতিক্রম করে, নাটকের স্রষ্টা ও দ্রষ্টা যেমন আছে। নাটকের সমস্তটাকে নিয়ে এবং তাকে পেরিয়ে । সত্তার এই দুই দিককে সব সময়ে মিলিয়ে অনুভব করতে পারি নে। একলা আপনাকে বিরাট থেকে বিচ্ছিন্ন করে সুখে দুঃখে আন্দোলিত হই । তার মাত্রা থাকে না, তার বৃহৎ সামঞ্জস্য দেখি নে । কোনো-এক সময়ে সহসা দৃষ্টি ফেরে তার দিকে, মুক্তির স্বাদ পাই তখন । যখন অহং আপনি ঐকাস্তিকতা ভোলে তখন দেখে সত্যকে । আমার এই অনুভূতি কবিতাতে প্ৰকাশ পেয়েছে ‘জীবনদেবতা” শ্রেণীর কাব্যে । e3(5 VOVKINOAN, মিটেছে কি তব সকল তিয়াষ। আসি অন্তরে মম | আমি যে পরিমাণে পূর্ণ অর্থাৎ বিশ্বভুমীন, সেই পরিমাণে আপন করেছি। তাকে, ঐক্য হয়েছে তার সঙ্গে । সেই কথা মনে করে বলেছিলুম, “তুমি কি খুশি হয়েছ। আমার মধ্যে তোমার লীলার প্রকাশ দেখে ।”