পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২০১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

>bro রবীন্দ্র-রচনাবলী থেকে কাচি টেনে নিয়ে ঘাড় পর্যন্ত চুল কেটে ফেললে কচ কচ করে। মেসোমশায় তোমাকে দেখে আশ্চৰ। বললেন, এ কী কাও ৷ তুমি শাস্তমুখে অনায়াসে বললে, বড়ো গরম লাগে । তিনিও একটু হেসে সহজেই মেনে নিলেন। প্রশ্ন করলেন না, ভৎসনা করলেন না, কেবল কাচি নিয়ে সমান করে দিলেন তোমার চুল। তোমারই তো জেঠামশায় !” সরলা হেসে বললে, “তোমার যেমন বুদ্ধি ! তুমি ভাবছ এটা আমার ক্ষমার পরিচয় ? একটুকুও নয়। সেদিন তুমি আমাকে যতটা জব্দ করেছিলে তার চেয়ে অনেক বেশি জব্দ করেছিলুম আমি তোমাকে। ঠিক কি না বলে।” “খুব ঠিক। সেই কাটা চুল দেখে আমি কেবল কাদতে বাকি রেখেছিলুম। তার পরদিন তোমাকে মুখ দেখাতে পারি নি লজ্জায়। পড়বার ঘরে চুপ করে ছিলেম বসে। তুমি ঘরে ঢুকেই হাত ধ’রে আমাকে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গেলে বাগানের কাজে, যেন কিছুই হয় নি। আর-একদিনের কথা মনে পড়ে, সেই যেদিন ফাঙ্কন মাসে অকালে ঝড় উঠে আমার বিছন লাগাবার ঘরের চাল উড়িয়ে নিয়েছিল তখন তুমি এসে—” “থাক আর বলতে হবে না আদিতদা” ব’লে দীর্ঘনিশ্বাস ফেললে, “সে-সব দিন আর আসবে না” বলেই তাড়াতাড়ি উঠে পড়ল । আদিত্য ব্যাকুল হয়ে সরলার হাত চেপে ধরে বললে, “না যেয়ে না, এখনই যেয়ে না, কখন একসময়ে যাবার দিন আসবে তখন—” বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে বলে উঠল, “কোনোদিন কেন যেতে হবে। কী অপরাধ ঘটেছে। ঈর্ষ । আজ দশ বৎসর সংসারযাত্রায় আমার পরীক্ষা হল তারই এই পরিণাম ? কী নিয়ে ঈর্ষ। তা হলে তো তেইশ বছরের ইতিহাস মুছে ফেলতে হয়, যখন থেকে তোমার সঙ্গে আমার দেখা ।” “তেইশ বছরের কথা বলতে পারি নে ভাই, কিন্তু তেইশ বছরের এই শেষ বেলাতে ঈর্ষার কি কোনে কারণই ঘটে নি। সত্যি কথা তো বলতে হবে । নিজেকে জুলিয়ে লাভ কী। তোমার আমার মধ্যে কোনো কথা যেন অস্পষ্ট না থাকে।” আদিত্য কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইল, বলে উঠল, “অস্পষ্ট আর রইল না। অস্তরে অস্তরে বুঝেছি তুমি নইলে আমার জগৎ হবে ব্যর্থ। যার কাছ থেকে পেয়েছি তোমাকে জীবনের প্রথম বেলায়, তিনি ছাড়া আর কেউ তোমাকে কেড়ে নিতে পারবে না । M “কথা বোলোনা আদিতদা, দুঃখ আর বাড়িয়ে না। একটু স্থির হয়ে দাও ভাবতে।”