পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৬৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

$88 রবীন্দ্র-রচনাবলী এমনই প্রভু হয়ে বসে যে, তার হাত আর সহজে এড়াবার জে থাকে না। তবে ক্রমে সে গুণের প্রতি অবজ্ঞা এবং মহত্ত্বের প্রতি কৃপাকটাক্ষপাত করতে আরম্ভ করে। সম্প্রতি এ দেশেও তার অনেকগুলি দৃষ্টান্ত দেখা যায়। ডাক্তারিতে যদি কেহ পসার করতে ইচ্ছা করেন, তবে তার সর্বাগ্রেই জুড়ি গাড়ি এবং বড়ো বাড়ির আবখ্যক : এইজন্যে অনেক সময়ে রোগীকে মারতে আরম্ভ করবার পূর্বে নবীন ডাক্তার নিজে মরতে আরম্ভ করেন । কিন্তু আমাদের কবিরাজ মহাশয় যদি চটি এবং চাদর পরে পালকি অবলম্বনপূর্বক যাতায়াত করেন তাতে তার পসারের ব্যাঘাত করে না । কিন্তু একবার যদি গাড়ি ঘোড়া ঘড়ি ঘড়ির-চেনকে আমল দেওয়া হয় তবে সমস্ত চরক-সুশ্ৰুত-ধন্বন্তরীর সাধ্য নেই যে, আর তার হাত থেকে পরিত্রাণ করে। ইন্দ্রিয়স্থত্রে জড়ের সঙ্গে মানুষের একটা ঘনিষ্ঠ কুটুম্বিত আছে, সেই সুযোগে সে সর্বদাই আমাদের কর্তা হয়ে উঠে। এইজন্যে প্রতিমা প্রথমে ছল করে মন্দিরে প্রবেশ করে তার পরে দেবতাকে অতিষ্ঠ করে তোলে। গুণের বাহ নিদর্শনস্বরূপ হয়ে ঐশ্বর্য দেখা দেয় অবশেষে বাহাড়ম্বরের অম্বুবতী হয়ে না এলে গুণের আর সম্মান থাকে না । বেগবতী মহানদী নিজে বালুক সংগ্রহ করে এনে অবশেষে নিজের পথরোধ করে বসে। যুরোপীয় সভ্যতাকে সেই রকম প্রবল নদী বলে এক-একবার মনে হয় । তার বেগের বলে, মানুষের পক্ষে যা সামান্য আবশ্বক এমন-সকল বস্তুও চতুর্দিক থেকে আনীত হয়ে রাশীকৃত হয়ে দাড়াচ্ছে । সভ্যতার প্রতি বর্ষের আবর্জন৷ পর্বতাকার হয়ে উঠছে। আর আমাদের সংকীর্ণ নদীটি নিতান্ত ক্ষীণস্রোত ধারণ ক’রে অবশেষে মধ্যপথে পারিবারিক ঘনশৈবালজালের মধ্যে জড়ীভূত হয়ে আচ্ছন্নপ্রায় হয়ে গেছে। কিন্তু তারও একটি শোভা সরসতা শু্যামলতা আছে । তার মধ্যে বেগ নেই, বল নেই, ব্যাপ্তি নেই, কিন্তু মৃদুতা স্নিগ্ধতা সহিষ্ণুতা আছে । আর, যদি আমার আশঙ্কা সত্য হয়, তবে যুরোপীয় সভ্যত হয়তো-বা তলে তলে জড়ত্বের এক প্রকাগু মরুভূমি স্বজন করছে ; গৃহ, যা মানুষের স্নেহপ্রেমের নিভৃত নিকেতন, কল্যাণের চিরউৎসভূমি, পৃথিবীর আর সমস্তই লুপ্ত হয়ে গেলেও যেখানে একটুখানি স্থান থাকা মানুষের পক্ষে চরম আবশ্বক, স্তৃপাকার বাহবস্তুর দ্বারা সেইখানটা উত্তরোত্তর ভরাট করে ফেলছে, হৃদয়ের জন্মভূমি জড় আবরণে কঠিন হয়ে উঠছে । নতুবা যে-সভ্যতা পরিবারবন্ধনের অনুকুল, সে-সভ্যতার মধ্যে কি নাইহিলিজ ম্ নামক অতবড়ো একটা সর্বসংহারক হিংস্র প্রবৃত্তির জন্মলাভ সম্ভব হয়। সোশ্বালিজম