পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩২৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৩০২ রবীন্দ্র-রচনাবলী বিধান ছিল না। আপিসের কাছে এবং এই আপিসের শহরের কাছে পুষ্পপল্লবচন্দ্রস্তুর্যের কোনো দাবি নাই, তাহ সজীব সরস বিশ্বপ্রকৃতির বক্ষ হইতে ছিনাইয়া লইয়। আমাদিগকে তাহার উত্তপ্ত জঠরের মধ্যে গিলিয়া পরিপাক করিয়া ফেলে। যাহার ইহাতেই অভ্যস্ত এবং যাহারা কাজের নেশায় বিহবল তাহারা এ সম্বন্ধে কোনো অভাবই অনুভব করে না— তাহারা স্বভাব হইতে ভ্ৰষ্ট হইয়া বৃহৎ জগতের সংস্রব হইতে প্রতিদিনই দূরে চলিয়া যায়। কিন্তু কাজের ঘূর্ণির মধ্যে ঘাড়মুড় ভাঙিয়া পড়িবার পূর্বে, শিখিবার কালে বাড়িয়া উঠিবার সময়ে, প্রকৃতির সহায়তা নিতান্তই চাই। গাছপালা, স্বচ্ছ আকাশ, মুক্তবায়ু, নির্মল জলাশয়, উদার দৃশ্ব, ইহার বেঞ্চি এবং বোর্ড, পুথি এবং পরীক্ষার চেয়ে কম আবশ্যক নয় । চিরদিন উদার বিশ্ব প্রকৃতির ঘনিষ্ঠসংস্রবে থাকিয়াই ভারতবর্ষের মন গড়িয়া উঠিয়াছে। জগতের জড়-উদ্ভিদ-চেতনের সঙ্গে নিজকে একান্তভাবে ব্যাপ্ত করিয়া দেওয়া ভারতবর্ষের স্বভাবসিদ্ধ হইয়াছে। ভারতবর্ষের তপোবনে দ্বিজবটুগণ এই মন্ত্র আবৃত্তি করিয়াছেন— যো দেবেহগ্নেী যোহপস্থ যো বিশ্বং ভূবনমাবিবেশ । য ওষধিযু যে বনস্পতিযু তস্মৈ দেবায় নমো নমঃ ॥ যে দেবতা অগ্নিতে, যিনি জলে, যিনি বিশ্বভুবনে আবিষ্ট হইয়া আছেন, যিনি ওষধিতে যিনি বনস্পতিতে সেই দেবতাকে নমস্কার করি, নমস্কার করি । অগ্নি বায়ু জলস্থল বিশ্বকে বিশ্বাত্মা দ্বারা সহজে পরিপূর্ণ করিয়া দেখিতে শেখাই যথার্থ শেখা। এই শিক্ষা শহরের ইস্কুলে ঠিকমতে সম্ভবে না ; সেখানে বিদ্যাশিক্ষার। কারখানাঘরে জগৎকে আমরা একটা যন্ত্র বলিয়াই শিখিতে পারি। Ꮉ কিন্তু এখনকার দিনের কাজের লোকের এ-সকল কথা মিষ্টিসিজম বা ভাবকুহেলিক। বলিয়। উড়াইয়া দিবেন, অতএব ইহা লইয়া সমস্ত আলোচনাটাকে অশ্রদ্ধাভাজন করিবার প্রয়োজন নাই । তথাপি, খোলা আকাশ খোলা বাতাস এবং গাছপালা মানবসস্তানের শরীরমনের সুপরিণতির জন্য যে অত্যন্ত দরকার এ কথা বোধ হয় কেজো লোকেরাও একেবারেই উড়াইয়া দিতে পরিবেন না। বয়স যখন বাড়িবে, আপিস যখন টানিবে, লোকের ভিড় যখন ঠেলিয়া লইয়৷ বেড়াইবে, মন যখন নানা মতলবে নানা দিকে ফিরিবে তখন বিশ্ব প্রকৃতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ হৃদয়ের যোগ অনেকটা বিচ্ছিন্ন হইয়া যাইবে । তাহার পূর্বে যে জলস্থল-আকাশবায়ুর চিরন্তন ধাত্ৰীক্রোড়ের মধ্যে জন্মিয়াছি, তাহার সঙ্গে