পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫১৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সমাজ 8&S) জাগাইতে আসিয়াছে। প্রাচীন ভারত তপোবনে বসিয়া একদিন এই জাগরণের মন্ত্র পাঠ করিয়াছিল : উত্তিষ্ঠত জাগ্রত প্রাপ্য বরান নিবোধত । ক্ষুরস্ত ধারা নিশিতা দুরত্যয় দুর্গং পথস্তং কবয়ে বদন্তি । উঠ, জাগো, যাহা-কিছু শ্রেষ্ঠ তাহাই প্রাপ্ত হইয়া প্রবুদ্ধ হও। কবিরা বলিতেছেন, সেই পথ ক্ষুরধারা শাণিত দুর্গম । Φι যুরোপও আমাদের রুদ্ধহৃদয়ের দ্বারে আঘাত করিয়া সেই মন্ত্রের পুনরুচ্চারণ করিতেছে ; বলিতেছে, যাহা শ্রেষ্ঠ, তাহাই প্রাপ্ত হইয়া প্রবুদ্ধ হও । যাহা শ্রেষ্ঠ, তাহ অার-কেহ ভিক্ষাস্বরূপ দান করিতে পারে না ; আবেদনপত্রপুটে তাহ ধারণ করিতে পারে না, তাহা সন্ধান করিতে হইলে দুর্গম পথেই চলিতে হয়। সে পথ কোথায় । অরণ্যে সে-পথ আচ্ছন্ন হইয়া গেছে, তবু পিতামহদের পদচিহ্ন এখনও সে-পথ হইতে লুপ্ত হয় নাই । কিন্তু হায়, পথের চেয়ে সেই পথলোপকারী অরণ্যের প্রতিই আমাদের মমতা । আমাদের প্রাচীন মহত্বের মূলধারাটি কোথায় এবং তাহাকে নষ্ট করিয়াছে কোন বিকারগুলিতে, ইহা আমরা বিচার করিয়া স্বতন্ত্র করিয়া দেখিতে পারি না। স্বজাতিগর্ব মাঝে মাঝে আমাদের উপর ভর করে, তখন যেগুলি আমাদের স্বজাতির গর্বের বিষয় এবং যাহা লজ্জার বিষয়, যাহা সনাতন এবং যাহা অধুনাতন, যাহা স্বজাতির স্বরূপগত এবং যাহা আকস্মিক, ইহার মধ্যে আমরা কোনো ভেদ দেখিতে পাই না। যাহা আমাদের আছে তাহাকেই ভালো বলিয়া, যাহা আমাদের ছিল তাহাকে অবমানিত করি । এ কথা ভুলিয়া যাই, ভালোর প্রমাণ, সে-ভালোকে যাহারা আশ্রয় করিয়া আছে, তাহারাই। সবই যদি ভালো হইবে তবে আমরা ভ্ৰষ্ট হইলাম কী করিয়া । এ কথা মনে রাথিতে হইবে, যে-আদর্শ যথার্থ মহান তাহা কেবল কালবিশেষ বা অবস্থাবিশেষের উপযোগী নহে। তাহাতে মনুস্যকে মচুন্যত্ব দান করে, সে-মানুষ সকল কালে সকল অবস্থাতেই আপন শ্রেষ্ঠতা রাখিতে পারে। আমার দৃঢ়বিশ্বাস, প্রাচীন ভারতে যে-আদর্শ ছিল তাহা ক্ষণভঙ্গুর নহে ; বিলাতে গেলে তাহা নষ্ট হয় না, বাণিজ্যে প্রবৃত্ত হইলে তাহা বিকৃত হয় না, বর্তমানকালোপযোগী কর্মে নিযুক্ত হইতে গেলে তাহ অনাবশুক হইয়া উঠে না। যদি তাহ হইত, তবে সে-আদর্শকে মহান বলিতে পারিতাম না ।