পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৬১৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

○8 রবীন্দ্র-রচনাবলী ৭— শাজাহানকে যদি মানবাত্মার বৃহৎ ভূমিকার মধ্যে দেখা যায় তাহলে দেখতে পাই সম্রাটের সিংহাসনটুকুতে তার আত্মপ্রকাশের পরিধি নিঃশেষ হয় না— ওর মধ্যে তাকে কুলোয় না বলেই এত বড়ো সীমাকেও ভেঙে র্তার চলে যেতে হয়— পৃথিবীতে এমন বিরাট কিছুই নেই যার মধ্যে চিরকালের মতো তাকে ধরে রাখলে তাকে খর্ব করা হয় না। আত্মাকে মৃত্যু নিয়ে চলে কেবলই সীমা ভেঙে ভেঙে । তাজমহলের সঙ্গে শাজাহানের যে-সম্বন্ধ সে কখনোই চিরকালের নয়— তার সঙ্গে তার সাম্রাজ্যের সম্বন্ধও সেইরকম। সে-সম্বন্ধ জীর্ণ পত্রের মতো খসে পড়েছে, তাতে চিরসত্যরূপী শাজাহানের লেশমাত্র ক্ষতি হয় নি । তাজমহলের শেষ দুটি লাইনের সর্বনাম ‘আমি’ ও ‘সে?— যে চলে যায় সে-ই হচ্ছে ‘সে’, তার স্মৃতিবন্ধন নেই,– আর যে-অহং কঁশদছে, সে-ই তো ভার-বওয়া পদার্থ। এখানে ‘আমি বলতে কবি নয়, ‘আমি-আমার ক’রে যেটা কান্নাকাটি করে সেই সাধারণ পদার্থটা। আমার বিরহ, আমার স্মৃতি, আমার তাজমহল, যে-মানুষটা বলে তারই প্রতীক ওই গোরস্থানে ; আর মুক্ত হয়েছে যে, সে লোকলোকাস্তরের যাত্রী— তাকে কোনো একখানে ধরে না, না তাজমহলে, না ভারতসাম্রাজ্যে, না শাজাহাননামরূপধারী বিশেষ ইতিহাসের ক্ষণকালীন অস্তিত্বে। (প্রবাসী, ১৩৪৮ কাতিক ) ৭ সংখ্যক কবিতাটির শেষাংশ সম্বন্ধে শ্রীপ্রমথনাথ বিশীকে একটি পত্রে ( ২১ শ্রাবণ, ১৩৪৪ ) রবীন্দ্রনাথ লিখিয়াছিলেন : যে-প্রেম সম্মুখপানে , । উড়ে পড়েছিল বীজ জীবনের মাল্য হতে খসা ৷ ইত্যাদি । কবিতা লিখেছি বলেই যে তার মানে সম্পূর্ণ বুঝেছি এমন কথা মনে করবার কোনো হেতু নেই। মন থেকে কথাগুলো যখন সদ্য উৎসারিত হচ্ছিল, তখন নিশ্চয়ই এর মধ্যে একটা মানের ইঙ্গিত প্রচ্ছন্ন ছিল । সেই অন্তর্যামীর কাজ সারা হতেই সে দৌড় দিয়েছে—। এখন বাইরে থেকে আমাকে মানে ভেবে বের করতে হবে— সেই বাইরের দেউড়িতে যেমন আমি আছি, তেমনি তুমিও আছ এবং আরও দশজন আছে, তাদের মধ্যে মতান্তর নিয়ে সর্বদাই হট্টগোল বেধে যায়। সেই গোলমালের মধ্যে আমার ব্যাখ্যাটি যোগ করে দিচ্ছি, যদি সন্তোষজনক ন মনে কর, তোমার বুদ্ধি খাটাও, আমার আপত্তি করবার অধিকার নেই বেগমমণ্ডলী পরিবৃত বাদশার যে প্রেম, কালিদাস হংসপদিকার মুখ থেকে তাকে লাঞ্ছিত করেছেন। সে প্রেম চলিত পথের । ধুলোর উপরে তার খেলাঘর। মমতাজ যথাসময়ে মারা গিয়েছিল বলেই বিরহের একটি সজীব বীজ সেই খেলাঘরের ধূলির উপরে পড়ে ধূলি হয়ে যায় নি, ক্লাস্তিপ্রবণ বিলাসের ক্ষণভঙ্গুরতা অতিক্রম করে আন্তরিত হয়েছিল। তার ভিতরকার অমরত। ক্ষণকালের পরম স্মৃতিকে বহন করে রয়ে গেল । যে-বেদনাকে সেই স্মৃতি ঘোষণা করছে, তারই সঙ্গে সঙ্গে তার আর-একটি ঘোষণা অাছে, তার বাণী হচ্ছে এই যে, সেই শাজাহানও নেই সেই মমতাজও নেই, কেবল তাদের যাত্রাপথের এক অংশের ধূলির উপরে জীবনের ক্ৰন্দনধ্বনি বহন করে রয়ে গেছে তাজমহল। দুষ্যস্ত-শকুন্তলার প্রেমের মধ্যে একটা মহিমা আছে, দুই তপোবনের