পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৬৩৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গ্রন্থপরিচয় や> > ( ১৩১৫ ভাদ্র ) প্রকাশিত হয়— “পূজনীয় শ্রযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয় সম্প্রতি ছাত্র-সমাজে যে-বক্তৃতা করেন ইহা তাহারই সংক্ষিপ্ত মৰ্ম” ৷ ভারতবর্ষের ইতিহাস কাহীদের ইতিহাস । প্রকৃতপক্ষে বলিতে গেলে ভারতের ইতিহাস কাহারও স্বতন্ত্র ইতিহাস নহে। যে-আর্যগণ একদিন তাহদের বুদ্ধিশক্তিপ্রভাবে তমসাচ্ছন্ন ভারতকে মহিমালোক সমুদ্ভাসিত করিয়া তুলিয়া ভারতেতিহাসের ভিত্তি স্থাপনা করিয়াছিলেন, যে-আর্যগণ অতঃপর অনার্যগণের সহিত মিশিয়া প্রতিলোম বিবাহে এবং অনার্যাচরিত বিবিধ আচারধর্ম দেবতা ও পূজাপ্রণালী গ্রহণে তাহাদিগকে সমাজান্তর্গত করিয়া লইয়া বৈদিক সমাজের সম্পূর্ণ বিরোধী আধুনিক সমাজকে গঠিত করিয়া তুলিয়াছিলেন, হিন্দুর আত্মঘাতী গৃহবিবাদের অবকাশে যেমুসলমান এ দেশে আসিয়া বংশপরম্পরাক্রমে জন্মমৃত্যু দ্বারা এ দেশের মাটিকে আপনার করিয়া লইল— ভারতের ইতিহাস ইহাদের মধ্যে কাহার।— স্বতন্ত্র কাহারও নহে। তবে সে কি হিন্দুমুসলমানের। তাহাও নহে। সংকীর্ণতার গণ্ডি দিয়া ইহাকে বাধিতে যাওয়া শুধু আমাদের অহংকার প্রকাশ করা মাত্র । ভারতবর্ষ কাহারও নিজস্ব সম্পত্তি নহে, এবং একদিন যে কোনো-এক বিশিষ্ট জাতি তাহার সর্বময় কর্তী হইয়া বসিবে তাহাও নহে। ভারতের ইতিহাস স্বত্বের ইতিহাস নহে, তাহা সত্যের ইতিহাস । যে মহান সত্য নানা আঘাত-সংঘাতের মধ্য দিয়া পরিপূর্ণ হইয়া উঠিতেছে, আমাদিগকে তাহারই সাহায্য করিতে হইবে। ব্যক্তিবিশেষ বা সমাজবিশেষের কর্তৃত্বলাভের চেষ্টায় মর্যাদা কিছু নাই। ভারতবর্ষক একটি অপূর্ব পরিপূর্ণকারে গড়িয়া তুলিতে হইবে। আমরা তাহার একটি উদাহরণমাত্র এ কথা যেন মনে রাখি। আমরা যদি দূরে দূরে থাকি বা নিজের স্বাতন্ত্র্যে খণ্ডাকারে প্রকাশিত হইতে চাই— সে নিৰুদ্ধিতার জন্য আমরাই দায়ী। আমরা যেটুকু মিলিতে পারিব সেইটুকুই সার্থক হইবে। যেটুকু গণ্ডিবদ্ধ সেটুকু নিরর্থক, এবং তাহার নাশ অবশ্যম্ভাবী । আজ যে পশ্চিম হইতে ইংরেজ আসিয়া ভারতেতিহাসের একটা প্রধান অংশ জুড়িয়া বসিয়াছে ইহা কি সম্পূর্ণ আকস্মিক, অপ্রয়োজনীয়। ইংরেজের নিকট কি আজ আমাদের শিখিবার কিছুই নাই। তিন সহস্ৰ বৎসর পূর্বে আমাদের পূর্বপুরুষগণ যাহা আমাদের দিয়া গিয়াছেন, বিশ্বমানব-ভাণ্ডারে তাহ অপেক্ষা নূতন জ্ঞান কি আর কিছুই থাকিতে পারে না । নিখিলমানবের সঙ্গে জ্ঞান প্রেম কর্মের নানা আদানপ্রদানে আমাদের অনেক প্রয়োজন আছে ; ইংরেজ বিধাতুপ্রণোদিত হইয়া তাহারই উদ্যম আমাদের মধ্যে জাগাইতে আসিয়াছে,— সফল না হওয়া পর্যস্ত সে নিশ্চিস্ত হইবে না । সে সফলতা পূর্ব ও পশ্চিমের মিলনে, বিরোধে নহে। ভারতবর্ষ হইতে অসময়ে ইংরেজকে তাড়াইবার আমাদের অধিকার ? অামরাই বা কাহারা – হিন্দু না মুসলমান ? বাঙালি না মারাঠি না পাঞ্জাবি ? যাহারা— যে সম্মিলিত সমষ্টি— একদিন সম্পূর্ণ সত্যের সহিত ‘আমরাই ভারতবর্ষ এ কথা বলিতে পারিবে, এ অহংকার তাহাদেরই মুখে শোভা পাইবে ।