পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৬৪১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

や〉br রবীন্দ্র-রচনাবলী পড়িয়াছে আমরা বিনা আপত্তিতে তাহার নিকট মস্তক নত করিয়া দিয়াছি ; স্বদেশের কথা, ভবিষ্যতের কথা এক মুহুর্তের জন্য ভাবিও নাই। আজ আমরা ইংরেজের কল্যাণে যদি-ব। আপত্তি করিতে শিখিলাম, অভাগার অদৃষ্ট এমনই, অনেক সময় দেশের মঙ্গল প্রস্তাবে আপত্তি করিয়া বসি । * বোধ হয়, আপত্তি করিতেই একটা সুখ আছে। নতুবা, স্বদেশী ভাষার সাহায্য ব্যতীত কখনোই স্বদেশের স্থায়ী কল্যাণ সাধিত হইতে পারে না, এ কথা কে না বোঝে। কিন্তু দুদৈবক্রমে সহজ কথা না বুঝিলে তাহার মতো কঠিন কথা আর নাই । কারণ, কঠিন কথা না বুঝিলে সহজ কথার সাহায্যে বুঝাইতে হয়, কিন্তু সহজ কথা না বুঝিলে আর উপায় দেখা যায় না। দেশের অধিকাংশ লোকের শিক্ষার উপর যদি দেশের উন্নতি নির্ভর করে, এবং সেই শিক্ষার গভীরতা ও স্থায়িত্বের উপর যদি উন্নতির স্থায়িত্ব নির্ভর করে, তবে মাতৃভাষা ছাড়া যে আর কোনো গতি নাই, এ কথা কেহ না বুঝিলে হাল ছাড়িয়া দিতে হয়। রাজা কত আসিতেছে কত যাইতেছে; পাঠান গেল, মোগল গেল, ইংরেজ আসিল আবার কালক্রমে ইংরেজও যাইবে, কিন্তু ভাষা সেই বাংলাই চলিয়া আসিতেছে এবং বাংলাই চলিবে ; যাহা-কিছু বাংলায় থাকিবে তাহাই যথার্থ থাকিবে এবং চিরকাল থাকিবে । ইংরেজ যদি কাল চলিয়া যায় তবে পরশ্ব ওই বড়ো বড়ো । বিদ্যালয়গুলি বড়ে। বড়ো সৌধ বুদ্ধ দের মতো প্রতীয়মান হইবে । ভালোরূপ নজর করিয়া দেখিলে আজও ওগুলাকে বুদ্ধ দ বলিয়া বোঝা যায়। উহারা আমাদের বৃহৎ লোকপ্রবাহের মধ্যে অত্যন্ত লঘুভাবে অতিশয় অল্প স্থান অধিকার করিয়া আছে। প্রবাহের গভীর তলদেশে উহাদের কোনো মূল নাই। তীরে বসিয়া ফেনের আধিক্য দেখিলে ভ্রম হয় তবে বুঝি আগাগোড়া এইরূপ ধবলাকার, একটু অস্তরে অবগাহন করিলেই দেখা যায় সেখানে সেই স্নিগ্ধ শীতল চিরকালের নীলাম্বুধারা। শিক্ষা যদি সেই তলদেশে প্রবেশ না করে, জীবন্ত মাতৃভাষার মধ্যে বিগলিত হইয়া চিরস্থায়িত্ব লাভ না করে, তবে সমাজের উপরিভাগে যতই অবিশ্রাম নৃত্য করুক এবং ফেনাইয়৷ উঠক তাহ ক্ষণিক শোভার কারণ হইতে পারে, চিরন্তন জীবনের উৎস হইতে পারে না। এ-সব কথা ইতিহাসে অনেকবার আলোচিত হইয়া গেছে, এবং অনেক ইংরেজ লেখকও এ কথা লিখিয়াছেন । জর্মানিতে যতদিন না মাতৃভাষার আদর হইয়াছিল ততদিন তাহার যথার্থ আত্মাদর এবং আত্মোন্নতি হয় নাই । শিক্ষণসভার যে-সভ্যগণ মাতৃভাষার প্রতি আপত্তি প্রকাশ করেন র্তাহার এ-সমস্ত উদাহরণ অবগত আছেন, সেইজন্যই কথাট। তাহদের বুঝানো আরও কঠিন, কারণ, বুঝাইবার কিছু নাই । আর-একটা যুক্তি আছে । এতদিনকার ইংরেজি শিক্ষাতেও শিক্ষিতগণের মধ্যে প্রকৃত মানসিক বিকাশ দেখা যায় না। র্তাহারা এমন-একটা কিছু করেন নাই যাহাকে পৃথিবীর একটা নূতন উপার্জন বলা যাইতে পারে, যাহাতে মহন্তজাতির একটা নূতন গৌরব প্রকাশ পাইয়াছে। কেহ কেহ ভালো ইংরেজি বলেন, কেহ কেহ বিশুদ্ধ উচ্চারণ রক্ষা করেন, কিন্তু ধাত্রীর অঞ্চল ছাড়িয়া কেহ এক পা ইটিতে পারেন না।