পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৬৪৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

७२९ রবীন্দ্র-রচনাবলী কিন্তু যে-ভাষার কিছুই জানি না সেই ভাষার ব্যাকরণ হইতেই যদি প্রথম ব্যাকরণ শিক্ষা হয়, তবে শিশুদের মস্তিষ্কের প্রতি কী অন্যায় উৎপীড়ন করা হয়। কর্তা কর্ম ক্রিয়া প্রভৃতি অ্যাবস্ট্রাক্ট শব্দগুলি ছেলেদের পক্ষে কত কঠিন সকলেই জানে ; উপযুপরি সহজ উদাহরণের দ্বারা ব্যাকরণের কঠিন সূত্রগুলি কথঞ্চিং বোধগম্য হয়। কিন্তু ভাষা এবং ব্যাকরণ দু’ই যখন বিদেশী তখন কাহার সাহায্যে কাহাকে বুঝিবে । তখন সূত্রও অপরিচিত, উদাহরণও অপরিচিত। যে ভাষা সর্বাপেক্ষা পরিচিত সেই ভাষার সাহায্যে ব্যাকরণজ্ঞান লাভ করাই প্রশস্ত নিয়ম ; অবশেষে একবার ব্যাকরণজ্ঞান জন্মিলে সেই ব্যাকরণের সাহায্যে অপরিচিত ভাষাশিক্ষা সহজ হইয়া আসে । অতএব, শিখিবার প্রণালীটি যদি একবার মাতৃভাষার সাহায্যে অপেক্ষণকৃত সহজে আয়ত্ত হইয়া আসে, মনটি যদি শিক্ষার জন্য প্রস্তুত হইয়া উঠে, তবে ধারণাশক্তি যে কতটা পরিপক্ক হইয়া উঠে, কত অনাবশ্যক পীড়ন, কঠিন চেষ্টা ও শরীরমনের অবসাদ হইতে নিষ্কৃতি পাওয়া যায়, কত অল্প সময়ে ও কত স্থায়ীরূপে নূতন শিক্ষা গ্রহণ করা যায়, তাহা যাহারা দৃষ্টান্ত দেখিয়াছেন তাহারাই জানেন । বাল্যকাল হইতেই ইংরেজিভাষা শিক্ষা দেওয়া হউক কিন্তু বাংলার আনুষঙ্গিক রূপে অতি অল্পে অল্পে, তাহা হইলে বাংলাশিক্ষ। ইংরেজিশিক্ষার সাহায্য করিবে । ইতিহাস ভূগোল অঙ্ক প্রভৃতি শিক্ষার বিষয়গুলি বাংলায় শিখাইয়া ইংরেজিকে কেবল ভাষাশিক্ষা রূপে শিখাইলে ভাষারূপে ইংরেজি শিখিবার সময় অধিক পাওয়া যায় ; বুঝিয়া পড়িবার এবং অভ্যাস করিয়া লিখিবার যথার্থ অবসর থাকে। সকলেই জানেন, আজকাল আমাদের ছাত্রের যে-পরিমাণে অনেক বিষয় শেখে সেই পরিমাণে ইংরেজি অল্প শেখে। তাহার প্রধান কারণ, আগাগোড়া মুখস্থ করিতে গিয়া ইংরেজি বুঝিবার এবং রচনা করিবার সময় পায় না। শিক্ষণীয় বিষয়গুলি যদি বাংলায় পাইতাম তবে ইংরেজিভাষাশিক্ষা যে কত সহজসাধ্য হইত তাহ বলা যায় ন। তাহ হইলে শিক্ষার বিষয়গুলি এখনকার অপেক্ষা গভীরতর এবং ইংরেজিভাষাজ্ঞানের পরীক্ষা এখনকার অপেক্ষা অনায়াসে দুরূহতর করা যাইতে পারিত । বঙ্কিমবাবুর ক্ষীণস্বর র্যাহীদের শ্রুতিগম্য হয় নাই, আমার এ ক্ষুদ্র প্রবন্ধ তাহদের দৃষ্টিগোচর হইবে না, হইলেও কোনো ফলের প্রত্যাশা করি না। কিন্তু যে-পাঠকগণ অনুগ্রহ অথবা অনুরাগ -বশত আমাদের বাংলাকাগজ পড়িয়া থাকেন তাহদের প্রতি কিঞ্চিং ভরসা রাখি । র্তাহারা যদি দেশের মঙ্গলের জন্য কথাটা ভালো করিয়া বিবেচনা করিয়া দেখেন, এবং ঘরে ঘরে আপন আপন সন্তানকে মাতৃস্তন্তের ন্যায় মাতৃভাষার দ্বারা সম্যকৃরূপে পরিপুষ্ট ও পরিণত করিয়া তুলিতে চেষ্টা করেন তবে কালক্রমে দেশের যে শ্ৰী ও উন্নতি হইবে সভাসমিতিতে সহস্ৰ বৎসর ইংরেজি বক্তৃতা করিয়াও সেরূপ হইবে না। কেবল ভয় হয় এইজন্য যে, বাঙালি স্থায়ী গৌরব অপেক্ষা ক্ষণিক অহংকার-তৃপ্তি অধিক ভালোবাসে, ভবিষ্যৎ কার্যসিদ্ধির অপেক্ষা উপস্থিত করতালির জন্য অধিক লালায়িত ; এবং দেশের বৃহৎ কল্যাণ অপেক্ষ আশু ক্ষুদ্র স্বার্থের প্রলোভন গুরুতর ; তাহা ছাড়া মুখে যেমনই গর্ব করি, আত্মশক্তি আত্মভাষা এবং কোনো আপনার জিনিসের প্রতিই আমাদের আস্তরিক বিশ্বাস নাই ; মনে স্থির করিয়া বসিয়া আছি যে, ইংরেজ গবর্মেন্ট আমাদের সমস্ত উন্নতিসাধন করিয়া দিবে,