পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৬৪৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী 8 جولا নিযুক্ত হওয়া অন্যায়। অধ্যয়নই যে ছাত্রজীবনের প্রধান কর্তব্য এবং অধ্যয়নে যতই অবহিত হইতে পারা যায়, ততই যে সফলতা লাভের বেশি সম্ভাবনা, এ কথা অস্বীকার করিবার উপায় নাই। কিন্তু এ কথাও ঠিক যে, সকল দেশেই বিশেষ বিশেষ সংকটের সময় এ নিয়মের ব্যতিক্রম হইয়া থাকে। তখন বয়স্কেরা ব্যাবসা ছাড়িয়া, যুবকেরা আমোদ প্রমোদ ছাড়িয়া, ছাত্রের অধ্যয়ন ছাড়িয়া আন্দোলনে যোগদান করিয়া থাকেন। সর্বত্রই এইরূপ ঘটে এবং এরূপ ঘটাই স্বাভাবিক। বর্তমান সময়ে আমরা আমাদের মধ্যে নবজীবনের একটা উত্তেজনা অনুভব করিতেছি । বৃদ্ধেরাও বিষয়কর্ম পরিত্যাগ করিয়া এমন উৎসাহের সহিত বর্তমান আন্দোলনে মাতিয়৷ গিয়াছেন যে, তাহদের আবার যদি কোনো বৃদ্ধতর অভিভাবক থাকিতেন, তবে তাহারা নিঃসন্দেহই বলিতেন যে, ইহাদের এই কাজ বৃদ্ধোচিত হইতেছে না। ছাত্রগণ যে এ আন্দোলনে যোগ দিয়াছেন, তাহা নিতান্ত স্বাভাবিক, বিশেষত আমাদের দেশে । যে-সমাজের সমস্ত শক্তি সম্মিলিত হইয়া আপনার অভাব মোচনে নিযুক্ত থাকে, সে-সমাজে বরং ছাত্রের স্বতন্ত্র থাকিতে পারেন। আমাদের সমাজের তো সেরূপ স্বাস্থ্যের অবস্থা মহে । আমাদের রাজা বিদেশী, প্রজার বেদন বোঝেন না, বুঝিলেও অনেক সময়ে উভয়ের স্বার্থের সংঘর্ষ উপস্থিত হয়। আবার, ইহারাই আমাদের শিক্ষক। ইংরেজের সমাজ স্বাধন, সেখানে রাজা ও প্রজার মধ্যে জেত-বিজিতের সম্পর্ক নাই। কাজেই এমন বিরোধও উপস্থিত হয় না । সেখানকার ছাত্রেরা এই বলিয়া নিশ্চিন্ত থাকিতে পারে যে, স্টেট সর্বপ্রযত্বে তাহণদের মঙ্গল চিন্তাই করিতেছে। কিন্তু বিশেষ কোনো সংকট উপস্থিত হইলে তাহারাও যে বিচলিত হইয়া থাকে, তাহার প্রমাণের অভাব নাই । অামাদের দেশে শিক্ষার ভার র্যাহাদিগের হস্তে ন্যস্ত আছে, তাহীদের স্বার্থের সঙ্গে ছাত্রদের স্বার্থের বিরোধ। সুতরাং ছাত্রেরা যে সকল সময় সকল বিষয়ে শিক্ষাগুরুদিগের অতুবতী হইয়া চলিবে, তাহ সম্ভবপরও নহে, সমাজের পক্ষে স্বাস্থ্যকরও নহে। সকলেই জানেন যে, মুখগহবর নিশ্বাস গ্রহণের জন্য অভিপ্রেত হয় নাই, নাসাই নিশ্বাস গ্রহণের প্রকৃত দ্বার। কিন্তু যখন ফুসফুস বিকৃত হইয়া পড়ে, তখন মুখগহবরকেই সেই কাজ করিতে হয়। সমাজে যদি কখনও এমনতরে অবস্থা উপস্থিত হয় যে, তাহার নাসা যথানির্দিষ্ট কাজ করিতে পারিতেছে না, তখন কি বলিব যে তার মুখ বন্ধ হইয়া থাকুক। ছাত্রেরা যদি আবালবৃদ্ধবনিতার সঙ্গে বর্তমান আন্দোলনে যোগ দিয়া থাকেন, তবে সে আনন্দেরই কথা। এই স্বদেশীআন্দোলন যে কৃত্রিম, সে কথা তো কেহ বলিতে পারিবে না। আজ যে ' ছাত্রেরা উন্মত্ত, জনসাধারণ উত্তেজিত এবং বৃদ্ধেরণও উত্তপ্ত হইয়া উঠিয়াছেন, ইহাতে স্পষ্টই মনে হয় যে, সকলে মিলিয়া দেশকে এক মহাসংকট হইতে রক্ষা করিবার জন্য উদ্যত হইয়াছেন । ইহা দেখিয়া যাহারা আতঙ্কিত হইয়া উঠিয়াছেন, র্তাহারা দেশকলপাত্রভেদে যে অবস্থার ভেদ হয়, তাহা বিবেচনা করেন না। অামাদের দেশের চাষাদিগকেও যদি আজি জিজ্ঞাসা করা যায়, “তোমরা স্বদেশী জিনিস ব্যবহার করিতেছ কেন।” তবে তাহারা বলে 'হুকুম হইয়াছে’। হুকুমই বটে, কিন্তু এ হুকুম তো কোনো নেতার হুকুম নয়। কোন স্বৰ্গ হইতে এ হুকুম নামিয়া আসিয়াছে কে বলিতে