পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৩৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চণ্ডালিকা : Q ) পারে নি। তিনি সহজেই বললেন, জল দাও । ঐটুকু বাণী, তার তেজ কত— আলো ক’রে দিলে আমার সমস্ত জন্ম ; বুকের উপরে কালো পাথরটা চিরকাল চাপা ছিল, দিলে সেটাকে ঠেলে, উছলে উঠল। রসের ধারা । মিথ্যে তোর ভয়, তুই যে তঁাকে দেখিস নি। সমস্ত সকাল বেলা ভিক্ষা শেষ করলেন শ্রাবন্তীনগরে ; এলেন মাঠ পেরিয়ে শ্মশান পেরিয়ে, নদীর তীর বেয়ে, প্রখর রৌদ্র মাথায় করে । কিসের জন্যে । আমার মতো মেয়েকেও কেবল ঐ একটি কথা বলবার জন্যে- জল দাও ! মরে যাই, মরে য়াই । কোথা থেকে নামল এত দয়া, এত প্ৰেম ! নামল সেই ভীরুর কাছে যে সবার চেয়ে অযোগ্য । আর কিসের ভয় আমার ! জল দাও ! সেই জল-যে আমার জন্ম ভরে উপচে উঠেছে, না দিতে পারলে তো বঁচিব না । জল দাও ! এক নিমেষে জেনেছি, জল আছে আমার, অফুরান জল, সে আমি জানাব। কাকে । তাই তো ডাকছি। দিনরাত । শুনতে যদি না পান, ভয় নেই, দে তোর মন্তর পড়ে । সইবে তার সইবে । মা। মাঠপারের রাস্তা দিয়ে ঐ-যে কারা চলেছে, প্রকৃতি, পীতবসন-পরা । প্রকৃতি । তাই তো, ও যে দেখছি সংঘের সব শ্রমণ। শুনিছ না, পড়ছেন মন্ত্ৰ ! পথে শ্রমণের । বুদ্ধে সুসুদ্ধে করুণামহাবো প্রকৃতি। মা, ঐ-যে তিনি চলেছেন সবার আগে আগে। এই কুয়ােতলার দিকে ফিরে তাকালেন না । আর-একবার তো বলে যেতে পারতেন, জল দাও । মনে হয়েছিল, আমাকে উনি ফেলে যেতে পারবেন না, আমি যে ওঁর নিজের হাতের নতুন সৃষ্টি । (বসে পড়ে বার বার মাটিতে মাথা ঠুকে) এই মাটি, এই মাটি, এই মাটিই তোর আপনি- হতভাগিনী, কে তোকে আলোতে ফুটিয়ে তুলেছিল এক মুহুর্তের জন্যে। তাকে কি দয়া বলে। শেষে পড়তে হল এই মাটিতেই— চিরদিন মিশিয়ে থাকতে হবে এই মাটিতেই, যত লোক চলে রাস্তায় তাদের পায়ের তলায় । মা। বাছা, ভুলে যা, ভুলে যা এ সমস্ত-কিছু। তোর এক নিমেষের স্বপ্ন ভেঙে দিয়ে ওরা যাচ্ছে চলে, যাক যাক । যা টেকবার নয় তা যত শীঘ্ৰ যায় ততই ভালো । * প্রকৃতি । এই প্রতিদিনের চাই চাই চাই, এই প্রতি মুহুর্তের অপমান, বুকের ভিতরে এই খাচার পাখির পাখা-আছড়ে-মরা, একেই বলে স্বপ্ন ? যা বুকের সব শিরা কামড়ে ধরে থাকে, ছাড়তে চায় না, তাই স্বপ্ন ? আর ঐ ওরা, নেই কোনো বাধন, নেই কোনো সুখদুঃখ, নেই কোনো সংসারের বোঝাভেসে চলে যায় শরৎকালের মেঘের মতো- ওরাই আছে জেগে, ওরাই স্বপ্ন নয় ? মা । তোর কষ্ট দেখতে পারি নে, প্রকৃতি । ওঠ তুই । আনব্বই তাকে মন্ত্র পড়ে। নিয়ে আসব ভুল পথ ধরেই। কিছুচাইল বলার অহংকার ভাণ্ডৰ উচ্চ-গুই চাই বলেই আসতে হবে তাকে প্রকৃতি । মা, তোমার মন্ত্র জীবসৃষ্টির আদিকালের । এদের মন্ত্র কাচা, এই সেদিনকার । ওরা পারবে না তোমার সঙ্গে । তোমার মন্ত্রের টানে খুলবে ওদের মন্ত্রের গাঠ । ঔকে হারিতেই হবে, হারাতেই হবে । মা । কোথায় যাচ্ছে ওরা । প্রকৃতি । ওরা যায় এইমাত্র জানি, ওরা কোনোখানেই যায় না। বর্ষা আসবে কিছুদিন পরে, তখন বসবে চাতুর্মাস্যে । আবার যাবে, কী জানি কোথায় । একেই ওরা বলে জেগে থাকা ! शि পাগলি, তবে কী বলছিস মন্তরের কথা। চলে যাচ্ছে কত দূরে— কোথা থেকে আনব প্রকৃতি । যেখানেই যাক ফেরাতেই হবে, দূর নেই তোর মন্তরের কাছে।