পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩২৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী وQ)QU\ এ লইয়া কিরণ তাহার দেবরের কাছে কত দুঃখই করিয়াছে। বংশী বুদ্ধিমান ; তাহার খাওয়া হজম হয় না এবং একটু হাওয়া লাগিলেই সে হাঁচিয়া কাশিয়া অস্থির হইয়া উঠে, কিন্তু সে স্থির ধীর বিচক্ষণ । সে তাহার আইনের বইয়ের যে অধ্যায়টি পড়িতেছিল। সেইটেকে টেবিলের উপর খোলা অবস্থায় উপপুড় করিয়া রাখিয়া কিরণকে বলিল, “এ পাগলামি ছাড়া আর কিছুই নহে।” কিরণ অত্যন্ত উদবেগের সহিত মাথা নাড়িয়া কহিল, “জান তো, ঠাকুরপো ? তোমার দাদা যখন ভালো আছেন তখন বেশ আছেন, কিন্তু একবার যদি খ্যাপেন। তবে তাহাকে কেহ সামলাইতে পারে না । আমি কী করি বলো তো ।” পরিবারের সকল প্রকৃতিস্থ লোকের সঙ্গেই যখন কিরণের মতের সম্পূর্ণ মিল হইল, তখন সেইটেই বনোয়ারির বুকে সকলের চেয়ে বাজিল। এই একটুখানি স্ত্রীলোক, অনতিস্ফুট চাপাফুলটির মতো পেলাব, ইহার হৃদয়টিকে আপন বেদনার কাছে টানিয়া আনিতে পুরুষের সমস্ত শক্তি পরাস্ত হইল । আজকের দিনে কিরণ যদি বনোয়ারির সহিত সম্পূর্ণ মিলিতে পারিত তবে তাহার হৃদয়ক্ষত দেখিতে দেখিতে এমন করিয়া বাড়িয়া উঠিত না । মধুকে রক্ষা করিতে হইবে এই অতি সহজ কর্তব্যের কথােটা, চারি দিক হইতে তাড়নার চােটে, বনোয়ারির পক্ষে সত্য-সত্যই একটা খ্যাপামির ব্যাপার হুইয়া উঠিল । ইহার তুলনায় অন্য সমস্ত কথাই তাহার কাছে তুচ্ছ হইয়া গেল । এ দিকে জেল হইতে নীলকণ্ঠ এমন সুস্থভাবে ফিরিয়া আসিল যেন সে জামাই ষষ্ঠীর নিমন্ত্রণ রক্ষা করিতে গিয়াছিল । আবার সে যথারীতি অমানবদনে আপনার কাজে व्लाक्रिश (रुब्न । মধুকে ভিটাছাড়া করিতে না পারিলে প্রজাদের কাছে নীলকণ্ঠের মান রক্ষা হয় না । মানের জন্য সে বেশি কিছু ভাবে না, কিন্তু প্ৰজারা তাহাকে না মানিলে তাহার কাজ চলিবে না, এইজন্যই তাহাকে সাবধান হইতে হয় । তাই মধুকে তৃণের মতো উৎপাটিত করিবার জন্য তাহার নিড়ানিতে শান দেওয়া শুরু হইল । এবার বনোয়ারি। আর গোপনে রহিল না । এবার সে নীলকণ্ঠকে স্পষ্টই জানাইয়া দিল যে, যেমন করিয়া হউক মধুকে উচ্ছেদ হইতে সে দিবে না। প্রথমত, মধুর দেনা সে নিজে হইতে সমস্ত শোধ করিয়া দিল ; তাহার পরে আর-কোনো উপায় না দেখিয়া সে নিজে গিয়া ম্যাজিস্ট্রেটকে জানাইয়া আসিল যে, নীলকণ্ঠ অন্যায় করিয়া মধুকে বিপদে ফেলিবার উদযোগ করিতেছে। হিতৈষীরা বনোয়ারিকে সকলেই বুঝাইল, যেরূপ কাণ্ড ঘটিতেছে তাহাতে কোনদিন মনোহর তাহাকে ত্যাগ করিবে । ত্যাগ করিতে গেলে যে-সব উৎপাত পোহাইতে হয় তাহা যদি না থাকিত তবে এতদিনে মনোহর তাহাকে বিদায় করিয়া দিত । কিন্তু, বনোয়ারির মা আছেন এবং আত্মীয়স্বজনের নানা লোকের নানা প্রকার মত, এই লইয়া একটা গোলমাল বাধাইয়া তুলিতে তিনি অত্যন্ত অনিচ্ছক বলিয়াই এখনো মনোহর চুপ করিয়া আছেন । এমনি হইতে হইতে একদিন সকালে হঠাৎ দেখা গেল, মধুর ঘরে তালা বন্ধ । রাতারাতি সে যে কোথায় গিয়াছে তাহার খবর নাই । ব্যাপারটা নিতান্ত অশোভন হইতেছে দেখিয়া নীলকণ্ঠ জমিদার-সরকার হইতে টাকা দিয়া তাহাকে সপরিবারে কাশী পাঠাইয়া দিয়াছে। পুলিস তাহা জানে, এজন্য কোনো গোলমাল হইল না। অথচ নীলকণ্ঠ কৌশলে গুজব রটাইয়া দিল য়ে, মধুকে তাহার স্ত্রী-পুত্ৰ-কন্যা-সমেত অমাবস্যারাত্রে কালীর কাছে বলি দিয়া মৃতদেহগুলি ছালায় পুরিয়া মাঝগঙ্গায় ডুবাইয়া দেওয়া হইয়াছে । ভয়ে সকলের শরীর শিহরিয়া উঠিল এবং নীলকণ্ঠের প্রতি জনসাধারণের শ্ৰদ্ধা পূর্বের চেয়ে অনেক পরিমাণে বাড়িয়া গেল । বনোয়ারি যাহা লইয়া মাতিয়া ছিল উপস্থিতমত তাহার শান্তি হইল। কিন্তু, সংসারটি তাহার কাছে আর পূর্বের মতো রহিল না । বংশীকে একদিন বনোয়ারি অত্যন্ত ভালোবাসিত ; আজ দেখিল, বংশী তাহার কেহ নহে, সে হালদারগোষ্ঠীর । আর, তাহার কিরণ, যাহার ধ্যানরূপটি যৌবনারম্ভের পূর্ব হইতেই ক্ৰমে ক্রমে তাহার হৃদয়ের লতাবিতানটিকে জড়াইয়া জড়াইয়া আচ্ছন্ন করিয়া রহিয়াছে, সেও সম্পূর্ণ তাহার নহে, সেও