পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৩২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VS 8 রবীন্দ্র-রচনাবলী ভুলাইবার জন্য জালিয়াতির চেষ্টা করে নাই। ভারি একখানি সাদাসিধা মুখ, সাদাসিধা দুটি চােখ, এবং সাদাসিধা একটি শাড়ি । কিন্তু, সমস্তটি লইয়া কী যে মহিমা সে আমি বলিতে পারি না । যেমন তেমন একখানি চৌকিতে বসিয়া, পিছনে একখানা ডোরা-দাগ-কাট শতরঞ্চি ঝোলানো, পাশে একটা টিপাইয়ের উপরে ফুলদানিতে ফুলের তোড়া। আর, গালিচার উপরে শাড়ির বঁাকা পাড়টির নীচে দুখানি খালি পা । পটের ছবিটির উপর আমার মনের সোনার কাঠি লাগিতেই সে আমার জীবনের মধ্যে জাগিয়া উঠিল । সেই কালো দুটি চোখ আমার সমস্ত ভাবনার মাঝখানে কেমন করিয়া চাহিয়া রহিল। আর, সেই বাকা পাড়ের নীচেকার দুখানি খালি পা আমার হৃদয়কে আপন পদ্মাসন করিয়া লইল । পঞ্জিকার পাতা উলটাইতে থাকিল ; দুটা-তিনটা বিবাহের লগ্ন পিছাইয়া যায়, শ্বশুরের ছুটি আর মেলে না । ও দিকে সামনে একটা অকাল চার-পাচটা মাস জুড়িয়া আমার আইবড় বয়সের সীমানাটাকে উনিশ বছর হইতে অনর্থক বিশ বছরের দিকে ঠেলিয়া দিবার চক্রান্ত করিতেছে । শ্বশুরের এবং তাহার মনিবের উপর রাগ হইতে লাগিল । যা হউক, অকালের ঠিক পূর্বলগ্নটাতে আসিয়া বিবাহের দিন ঠেকিল। সেদিনকার সানাইয়ের প্ৰত্যেক তানটি যে আমার মনে পড়িতেছে। সেদিনকার প্রত্যেক মুহূর্তটিকে আমি আমার সমস্ত চৈতন্য দিয়া স্পর্শ করিয়াছি। আমার সেই উনিশ বছরের বয়সটি। আমার জীবনে অক্ষয় হইয়া থাক । বিবাহসভায় চারি দিকে হট্টগোল ; তাহারই মাঝখানে কন্যার কোমল হাতখানি আমার হাতের উপর পড়িল । এমন আশ্চর্য আর কী আছে । আমার মন বার বার করিয়া বলিতে লাগিল, “আমি পাইলাম, আমি ইহাকে পাইলাম।” কাহাকে পাইলাম । এ যে দুর্লভ, এ যে মানবী, ইহার রহস্যের কি অন্ত আছে । আমার শ্বশুরের নাম গৌরীশংকর । যে হিমালয়ে বাস করিতেন সেই হিমালয়ের তিনি যেন মিতা । তাহার গভীর্যের শিখরদেশে একটি স্থির হাস্য শুভ্ৰ হইয়া ছিল । আর, তাহার হৃদয়ের ভিতরটিতে মেহের যে একটি প্রস্রবণ ছিল তাহার ‘সন্ধান যাহারা জানিত তাহারা তাহাকে ছাড়িতে চাহিত না । কর্মক্ষেত্রে ফিরিবার পূর্বে আমার শ্বশুর আমাকে ডাকিয়া বলিলেন, “বাবা, আমার মেয়েটিকে আমি সতেরো বছর ধরিয়া জানি, আর তোমাকে এই ক'টি দিন মাত্র জানিলাম, তবু তোমার হাতেই ও রহিল । যে ধন দিলাম তাহার মূল্য যেন বুঝিতে পাের, ইহার বেশি আশীর্বাদ আর নাই ।” তাহার বেহাই বেহান সকলেই তাঁহাকে বার বার করিয়া আশ্বাস দিয়া বলিলেন, “ বেহাই, মনে কোনো চিন্তা রাখিয়ো না । তোমার মেয়েটি যেমন ব্যাপকে ছাড়িয়া আসিয়াছে, এখানে তেমনি বাপ মা উভয়কেই পাইল ।” তাহার পরে শ্বশুরমশায় মেয়ের কাছে বিদায় লইবার বেলা হাসিলেন ; বলিলেন, “বুড়ি চলিলাম । তোর একখানি মাত্র এই বাপ, আজ হইতে ইহার যদি কিছু খোওয়া যায় বা চুরি যায় বা নষ্ট হয় আমি তাহার জন্য দায়ী নই ৷” মেয়ে বলিল, “তই বৈকি। কোথাও একটু যদি লোকসান হয় তোমাকে তার ক্ষতিপূরণ করিতে হইবে ।” অবশেষে নিত্য তাহার যে-সব বিষয়ে বিভ্ৰাট ঘটে বােপকে সে-সম্বন্ধে সে বার বার সতর্ক করিয়া দিল । আহারসম্বন্ধে আমার শ্বশুরের যথেষ্ট সংযম ছিল না ; গুটিকয়েক অপথ্য ছিল, তাহার প্রতি তাহার বিশেষ আসক্তি- বাপকে সেই-সমস্ত প্রলোভন হইতে যথাসম্ভব ঠেকাইয়া রাখা মেয়ের এক কাজ ছিল । তাই আজ সে বাপের হাত ধরিয়া উদবেগের সহিত বলিল, “বাবা, তুমি আমার কথা রেখে - রাখবো ?” বাবা হাসিয়া কহিলেন, “মানুষ পণ করে পণ ভাঙিয়া ফেলিয়া হাফ ছাড়িবার জন্য । অতএব কথা না-দেওয়াই সব চেয়ে নিরাপদ ।” তাহার পরে বাপ চলিয়া আসিলে ঘরে কপাট পড়িল । তাহার পরে কী হইল কেহ জানে না ।