পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৩৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ናisiq}ጓ& VO SRS বাপ হাসিতে হাসিতেই বলিলেন, “ফের যদি আসি তবে সিধকাটি সঙ্গে করিয়াই আসিব ।” ইহার পরে হৈমর মুখে তাহার চিরদিনের সেই স্নিগ্ধ হাসিটুকু আর একদিনের জন্যও দেখি নাই । তাহারও পরে কী হইল সে কথা আর বলিতে পারিব না । শুনিতেছি মা পাত্রী সন্ধান করিতেছেন। হয়তো একদিন মারি অনুরোধ অগ্রাহ্য করিতে পারিব না, ইহাও সম্ভব হইতে পারে। কারণ- থাক আর কাজ কী ! জ্যৈষ্ঠ ১৩২১ বোষ্টমী আমি লিখিয়া থাকি অথচ লোকরঞ্জন আমার কলমের ধর্ম নয়, এইজন্য লোকেও আমাকে সদাসর্বদা যে রঙে রঞ্জিত করিয়া থাকে তাহাতে কালির ভাগই বেশি । আমার সম্বন্ধে অনেক কথাই শুনিতে হয় ; কপালক্রমে সেগুলি হিতকথা নয়, মনোহারী তো নহেই । শরীরে যেখানটায় ঘা পড়িতে থাকে সে জায়গাটা যত তুচ্ছই হােক সমস্ত দেহটাকে বেদনার জোরে সেই ছাড়াইয়া যায় । যে লোক গালি খাইয়া মানুষ হয়, সে আপনার স্বভাবকে যেন ঠেলিয়া একঝোকা হইয়া পড়ে । আপনার চারি দিককে ছাড়াইয়া আপনাকেই কেবল তাহার মনে পড়ে— সেটা আরামও নয়, কল্যাণও নয় । আপনাকে ভোলাটাই তো স্বস্তি । আমাকে তাই ক্ষণে ক্ষণে নির্জনের খোজ করিতে হয় । মানুষের ঠেলা খাইতে খাইতে মনের চারি দিকে যে টােল খাইয়া যায়, বিশ্বপ্ৰকৃতির সেবানিপুণ হাতখানির গুণে তাহা ভরিয়া উঠে । কলিকাতা হইতে দূরে নিভৃতে আমার একটি অজ্ঞাতবাসের আয়োজন আছে ; আমার নিজ-চৰ্চার দৌরাত্ম্য হইতে সেইখানে অন্তর্ধন করিয়া থাকি । সেখানকার লোকেরা এখনাে আমার সম্বন্ধে কোনাে একটা সিদ্ধান্তে আসিয়া পৌছে নাই । তাহারা দেখিয়াছে- আমি ভোগী নই, পল্লীর রজনীকে কলিকাতার কলুষে আবিল করি না ; আবার যোগীও নই, কারণ দূর হইতে আমার যেটুকু পরিচয় পাওয়া যায় তাহার মধ্যে ধনের লক্ষণ আছে ; আমি পথিক নহি, পল্লীর রাস্তায় ঘুরি বটে। কিন্তু কোথাও পৌছবার দিকে আমার কোনো লক্ষই নাই ; আমি যে গৃহী এমন কথা বলাও শক্ত, কারণ ঘরের লোকের প্রমাণাভাব । এইজন্য পরিচিত জীবশ্রেণীর মধ্যে আমাকে কোনো একটা প্ৰচলিত কোঠায় না। ফেলিতে পারিয়া গ্রামের লোক আমার সম্বন্ধে চিন্তা করা একরকম ছাড়িয়া দিয়াছে, আমিও নিশ্চিন্ত उांछि । অল্পদিন হইল খবর পাইয়াছি, এই গ্রামে একজন মানুষ আছে যে আমার সম্বন্ধে কিছু-একটা মনে ভাবিয়াছে, অন্তত বোকা ভাবে নাই । তাহার সঙ্গে প্ৰথম দেখা হইল, তখন আষাঢ়মাসের বিকালবেলা । কান্না শেষ হইয়া গেলেও চোখের পল্লব ভিজা থাকিলে যেমন ভাবটা হয়, সকালবেলাকার বৃষ্টি-অবসানে সমস্ত লতাপাতা আকাশ ও বাতাসের মধ্যে সেই ভাবটা ছিল । আমাদের পুকুরের উচু পাড়িটার উপর দাড়াইয়া আমি একটি নধর-শ্যামল গাভীর ঘাস খাওয়া দেখিতেছিলাম । তাহার চিকণ দেহটির উপর রৌদ্র পড়িয়াছিল দেখিয়া ভাবিতেছিলাম, আকাশের আলো হইতে সভ্যতা আপনার দেহটাকে পৃথক করিয়া রাখিবার জন্য যে এত দর্জির দোকান বানাইয়াছে, ইহার মতো এমন অপব্যয় আর নাই । এমন সময় হঠাৎ দেখি, একটি প্রৌঢ় স্ত্রীলোক আমাকে ভূমিষ্ঠ হইয়া প্ৰণাম করিল। তাহার আঁচলে কতকগুলি ঠোঙার মধ্যে করবী, গন্ধরাজ এবং আরো দুই-চার রকমের ফুল ছিল । তাঁহারই মধ্যে একটি আমার হাতে দিয়া ভক্তির সঙ্গে জোড়হাত করিয়া সে বলিল, “আমার ঠাকুরকে দিলাম।”- বলিয়া চলিয়া গেল ।