পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৪২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VO SR8 রবীন্দ্র-রচনাবলী ঠাকুরকে উহারা কিছুই দেয় না, অথচ ঠাকুরের ভোগে উহারাই সব চেয়ে বেশি করিয়া ভাগ বসায় । গরিবরা ভক্তি করে আর উপবাস করিয়া মরে । এ পাড়ার দুস্কৃতির কথা অনেক শুনিয়াছি, তাই বলিলাম, “এই সকল দুর্মতিদের মাঝখানে থাকিয়া ইহাদের মতিগতি ভালো করো, তাহা হইলেই তো ভগবানের সেবা হইবে।” এই রকমের সব উচুদরের উপদেশ অনেক শুনিয়াছি এবং অন্যকে শুনাইতেও ভালোবাসি। কিন্তু, বোষ্টমীর ইহাতে তাক লাগিল না। আমার মুখের দিকে তাহার উজ্জ্বল চক্ষু দুটি রাখিয়া সে বলিল, “তুমি বলিতেছে, ভগবান পাপীর মধ্যেও আছেন, তাই উহাদের সঙ্গ করিলেও তাঁহারই পূজা করা হয়। এই তো ?” আমি কহিলাম, “ই ।” সে বলিল, “উহারা যখন বাচিয়া আছে তখন তিনিও উহাদের সঙ্গে আছেন বৈকি। কিন্তু, আমার তাহাতে কী। আমার তো পূজা ওখানে চলিবে না ; আমার ভগবান যে উহাদের মধ্যে নাই। তিনি যেখানে আমি সেখানেই তাহাকে খুজিয়া বেড়াই ।” বলিয়া সে আমাকে প্ৰণাম করিল। তাহার কথাটা এই যে, শুধু মত লইয়া কী হইবে- সত্য যে চাই । ভগবান সর্বব্যাপী এটা একটা কথা, কিন্তু যেখানে আমি তাহাকে দেখি সেখানেই তিনি আমার ७J । এত বড়ো বাহুল্য কথাটাও কোনো কোনো লোকের কাছে বলা আবশ্যক যে, আমাকে উপলক্ষ করিয়া বেষ্টমী যে ভক্তি করে আমি তাহা গ্ৰহণও করি না, ফিরাইয়াও দিই না । এখনকার কালের ছোয়াচ আমাকে লাগিয়াছে । আমি গীতা পড়িয়া থাকি এবং বিদ্বান লোকদের দ্বারস্থ হইয়া তাহাদের কাছে ধর্মতত্ত্বের অনেক সূক্ষ্ম ব্যাখ্যা শুনিয়াছি। কেবল শুনিয়া শুনিয়াই বয়স বহিয়া যাইবার জো হইল, কোথাও তো কিছু প্ৰত্যক্ষ দেখিলাম না। এতদিন পরে নিজের দৃষ্টির অহংকার ত্যাগ করিয়া এই শাস্ত্ৰহীনা শ্ৰীলোকের দুই চক্ষুর ভিতর দিয়া সত্যকে দেখিলাম । ভক্তি করিবার ছলে শিক্ষা দিবার এ কী আশ্চর্য প্ৰণালী । পরদিন সকালে বোষ্টমী আসিয়া আমাকে প্ৰণাম করিয়া দেখিল, তখনো আমি লিখিতে প্ৰবৃত্ত । বিরক্ত হইয়া বলিল, “তোমাকে আমার ঠাকুর এত মিথ্যা খাটাইতেছেন কেন । যখনি আসি দেখিতে পাই, লেখা লইয়াই আছ ।” আমি বলিলাম, “যে লোকটা কোনো কর্মেরই নয়। ঠাকুর তাহাকে বসিয়া থাকিতে দেন না, পাছে সে মাটি হইয়া যায় । যত রকমের বাজে কাজ করিবার ভার তাহারই উপরে ।” আমি যে কত আবরণে আবৃত তাহাঁই দেখিয়া সে অধৈৰ্য হইয়া উঠে । আমার সঙ্গে দেখা করিতে হইলে অনুমতি লইয়া দোতলায় চড়িতে হয়, প্ৰণাম করিতে আসিয়া হাতে ঠেকে মোজাজোড়া, সহজ দুটাে কথা বলা এবং শোনার প্রয়োজন। কিন্তু আমার মনটা আছে কোন লেখার মধ্যে তলাইয়া । হাত জোড় করিয়া সে বলিল, “গীের, আজ ভোরে বিছানায় যেমনি উঠিয়া বসিয়াছি আমনি তোমার চরণ পাইলাম । আহা, সেই তোমার দুখানি পা, কোনো ঢাকা নাই- সে কী ঠাণ্ডা। কী কোমল । কতক্ষণ মাথায় ধরিয়া রাখিলাম। সে তো খুব হইল । তবে আর আমার এখানে আসিবার প্রয়োজন কী। প্ৰভু, এ আমার মোহ নয় তো ? ঠিক করিয়া বলে ।” লিখিবার টেবিলের উপর ফুলদানিতে পূর্বদিনের ফুল ছিল। মালী আসিয়া সেগুলি তুলিয়া লইয়া নূতন ফুল সাজাইবার উদযোগ করিল। ঘোষ্টমী যেন ব্যথিত হইয়া বলিয়া উঠিল, “বাস ? এ ফুলগুলি হইয়া গেল ? তোমার আর দরকার নাই ? তবে দাও দাও, আমাকে দাও ।” এই বলিয়া ফুলগুলি অঞ্জলিতে লইয়া, কতক্ষণ মাথা নত করিয়া, একান্ত স্নেহে এক দৃষ্টিতে দেখিতে লাগিল। কিছুক্ষণ পরে মুখ তুলিয়া বলিল, “তুমি চাহিয়া দেখো না বলিয়াই এ ফুল তোমার কাছে মলিন হইয়া যায়। যখন দেখিবে তখন তোমার লেখাপড়া সব ঘুচিয়া যাইবে ।”