পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৪৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ ՓՀ Գ বুজিলাম। পাছে কী দেখিতে হয় । এমন সময় পিছল ঘাটে সেই দিঘির জলে খোকার হাসি চিরদিনের মতো থামিয়া গেল । পার হইয়া আসিয়া সেই মায়ের কোলের-কঙাল ছেলেকে জলের তলা হইতে তুলিয়া কোলে লইলাম, কিন্তু আর সে “মা” বলিয়া ডাকিল না। আমার গোপালকে আমি এতদিন কাদাইয়াছি, সেই সমস্ত অনাদর আজ আমার উপর ফিরিয়া আসিয়া আমাকে মারিতে লাগিল । বঁচিয়া থাকিতে তাহাকে বরাবর যে ফেলিয়া চলিয়া গেছি, আজ তাই সে দিনরাত আমার মনকে আঁকড়িয়া ধরিয়া রহিল । আমার স্বামীর বুকে যে কতটা বাজিল সে কেবল তার অন্তর্যামীই জানেন । আমাকে যদি গালি দিতেন তো ভালো হইত ; কিন্তু তিনি তো কেবল সহিতেই জানেন, কহিতে জানেন না । এমনি করিয়া আমি যখন একরকম পাগল হইয়া আছি, এমন সময় গুরুঠাকুর দেশে ফিরিয়া আসিলেন । যখন ছেলেবিয়সে আমার স্বামী তাহার সঙ্গে একত্রে খেলাধুলা করিয়াছেন তখন সে এক ভাব ছিল । এখন আবার দীর্ঘকাল বিচ্ছেদের পর যখন তার ছেলেবিয়সের বন্ধু বিদ্যালাভ করিয়া ফিরিয়া আসিলেন তখন তাহার পরে আমার স্বামীর ভক্তি একেবারে পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল । কে বলিবে খেলার সাথি, ইহার সামনে তিনি যেন একেবারে কথা কহিতে পারিতেন না । আমার স্বামী আমাকে সাস্তুনা করিবার জন্য র্তাহার গুরুকে অনুরোধ করিলেন । গুরু আমাকে শাস্ত্ৰ শুনাইতে লাগিলেন । শাস্ত্রের কথায় আমার বিশেষ ফল হইয়াছিল বলিয়া মনে তো হয় না । আমার কাছে সে-সব কথার যা-কিছু মূল্য সে তাহারই মুখের কথা বলিয়া । মানুষের কণ্ঠ দিয়াই ভগবান তাহার অমৃত মানুষকে পান করাইয়া থাকেন ; আমন সুধাপাত্ৰ তো তার হাতে আর নাই। আবার, ঐ মানুষের কণ্ঠ দিয়াই তো সুধা তিনিও পান করেন । গুরুর প্রতি আমার স্বামীর অজস্র ভক্তি আমাদের সংসারকে সর্বত্র মৌচাকের ভিতরকার মধুর মতো ভরিয়া রাখিয়াছিল । আমাদের আহারবিহার ধনজন সমস্তই এই ভক্তিতে ঠাসা ছিল, কোথাও ফাক ছিল না। আমি সেই রসে আমার সমস্ত মন লইয়া ডুবিয়া তবে সাস্তুনা পাইয়াছি। তাই দেবতাকে আমার গুরুর রূপেই দেখিতে পাইলাম । তিনি আসিয়া আহার করিবেন এবং তার পর তার প্রসাদ পাইব, প্রতিদিন সকালে ঘুম হইতে উঠিয়াই এই কথাটি মনে পড়িত, আর সেই আয়োজনে লাগিয়া যাইতাম । তাহার জন্য তরকারি কুটিতাম, আমার আঙুলের মধ্যে আনন্দধ্বনি বাজিত । ব্ৰাহ্মণ নই, তাহাকে নিজের হাতে রাধিয়া খাওয়াইতে পারিতাম না, তাই আমার হৃদয়ের সব ক্ষুধাটা মিটিত না । তিনি যে জ্ঞানের সমুদ্র, সে দিকে তো তার কোন অভাব নাই । আমি সামান্য রমণী, আমি তাহাকে কেবল একটু খাওয়াইয়া-দাওয়াইয়া খুশি করিতে পারি, তাহাতেও এত দিকে এত ফাক ছিল । আমার গুরুসেবা দেখিয়া আমার স্বামীর মন খুশি হইতে থাকিত এবং আমার উপরে তাহার ভক্তি আরো বাড়িয়া যাইত । তিনি যখন দেখিতেন, আমার কাছে শাস্ত্রব্যাখ্যা করিবার জন্য গুরুর বিশেষ উৎসাহ, তখন তিনি ভাবিতেন, গুরুর কাছে বুদ্ধিহীনতার জন্য তিনি বরাবর অশ্রদ্ধা পাইয়াছেন, তাহার স্ত্রী এবার বুদ্ধির জোরে গুরুকে খুশি করিতে পারিল এই তাহার সৌভাগ্য । এমন করিয়া চার-পাচ বছর কোথা দিয়া যে কেমন করিয়া কাটিয়া গেল তাহা চোখে দেখিতে °व्नां न्ां । সমস্ত জীবনই এমনি করিয়া কাটিতে পারিত । কিন্তু, গোপনে কোথায় একটা চুরি চলিতেছিল, সেটা আমার কাছে ধরা পড়ে নাই, অন্তর্যামীর কাছে ধরা পড়িল । তার পর একদিনে একটি মুহুর্তে সমস্ত উলটাপালট হইয়া গেল । সেদিন ফায়ুনের সকালবেলায় ঘাটে যাইবার ছায়াপথে স্নান সারিয়া ভিজা-কাপড়ে ঘরে ফিরিতেছিলাম। পথের একটি বঁাকে আমতলায় গুরুঠাকুরের সঙ্গে দেখা । তিনি কঁধে একখানি গামছা লইয়া কোন-একটা সংস্কৃত মন্ত্র আবৃত্তি করিতে করিতে স্নানে যাইতেছেন । ,