পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৪৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

引雷g页 \OVSDN হবার দুঃখটুকু পেলুম। কিন্তু মা হবার মুক্তিটুকু পেলুম না । মনে আছে, ইংরেজ ডাক্তার এসে আমাদের অন্দর দেখে আশ্চর্য হয়েছিল এবং আঁতুড়ঘর দেখে বিরক্ত হয়ে বকবকি করেছিল । সদরে তোমাদের একটু বাগান আছে। ঘরে সাজসজা আসবাবের অভাব নেই। আর, অন্দরটা যেন পশমের কাজের উলটো পিঠ ; সেদিকে কোনো লজা নেই, শ্ৰী নেই, সজা নেই। সেদিকে আলো মিটমিটু করে জ্বলে ; হাওয়া চোরের মতো প্রবেশ করে ; উঠোনের আবর্জনা নড়তে চায় না ; দেয়ালের এবং মেজের সমস্ত কলঙ্ক অক্ষয় হয়ে বিরাজ করে । কিন্তু, ডাক্তার একটা ভুল করেছিল ; সে ভেবেছিল, এটা বুঝি আমাদের অহােরাত্র দুঃখ দেয় । ঠিক উলটো- অনাদর জিনিসটা ছাইয়ের মতো, সে ছাই আগুনকে হয়তো ভিতরে ভিতরে জমিয়ে রাখে। কিন্তু বাইরে থেকে তার তাপটকে বুঝতে দেয় না। আত্মসম্মান যখন কমে যায়। তখন অনাদরকে তো অন্যায্য বলে মনে হয় না । সেইজন্যে তার বেদনা নেই। তাই তো মেয়েমানুষ দুঃখ বোধ করতেই লজ্জা পায় । আমি তাই বলি, মেয়েমানুষকে দুঃখ পেতেই হবে, এইটে যদি তোমাদের ব্যবস্থা হয়, তা হলে যতদূর সম্ভব তাকে অনাদরে রেখে দেওয়াই ভালো ; আদরে দুঃখের ব্যথাটা কেবল বেড়ে ওঠে । যেমন করেই রাখ, দুঃখ যে আছে, এ কথা মনে করবার কথাও কোনোদিন মনে আসে নি । আঁতুড়ঘরে মরণ মাথার কাছে এসে দাঁড়াল, মনে ভয়ই হল না । জীবন আমাদের কীই-বা যে মরণকে ভয় করতে হবে ? অাদরে যত্বে যাদের প্রাণের বাধন শক্ত করেছে মরতে তাদেরই বাধে । সেদিন যম৷ যদি আমাকে ধরে টান দিত তা হলে আলগা মাটি থেকে যেমন অতি সহজে ঘাসের চাপড়া উঠে আসে। সমস্ত শিকড়সুদ্ধ আমি তেমনি করে উঠে আসতুম। বাঙালির মেয়ে তো কথায় কথায় মরতে যায় । কিন্তু, এমন মরায় বাহাদুরিটা কী । মরতে লজ্জা হয় ; আমাদের পক্ষে ওটা এতই সহজ । আমার মেয়েটি তো সন্ধ্যাতারার মতো ক্ষণকালের জন্যে উদয় হয়েই অস্ত গেল । আবার আমার নিত্যকর্ম এবং গোরুবাছুর নিয়ে পড়লুম। জীবন তেমনি করেই গড়াতে গড়াতে শেষ পর্যন্ত কেটে যেত ; আজকে তোমাকে এই চিঠি লেখবার দরকারই হত না । কিন্তু, বাতাসে সামানা একটা বীজ উড়িয়ে নিয়ে এসে পাকা দালানের মধ্যে অশথগাছের অন্ধুর বের করে ; শেষকালে সেইটুকু থেকে ইটকাঠের বুকের পাজার বিদীর্ণ হয়ে যায়। আমার সংসারের পাকা বন্দোবস্তের মাঝখানে ছোটাে একটুখানি জীবনের কণা কোথা থেকে উড়ে এসে পড়ল ; তার পর থেকে ফাটল শুরু হল । বিধমা মার মৃত্যুর পরে আমার বড়ো জায়ের বোন বিন্দু তার খুড়ততো ভাইদের অত্যাচারে আমাদের বাড়িতে তার দিদির কাছে এসে যেদিন আশ্রয় নিলে, তোমরা সেদিন ভাবলে, এ আবার কোথাকার আপদ । আমার পোড়া স্বভাব, কী করব বলো- দেখলুম, তোমরা সকলেই মনে মনে বিরক্ত হয়ে উঠেছ, সেইজন্যেই এই নিরাশ্রয় মেয়েটির পাশে আমার সমস্ত মন যেন একেবারে কোমর বেঁধে দাঁড়াল। পরের বাড়িতে পরের অনিচ্ছাতে এসে আশ্রয় নেওয়া- সে কত বড়ো অপমান । দায়ে পড়ে সেও যাকে স্বীকার করতে হল, তাকে কি এক পাশে ঠেলে রাখা যায়। তার পরে দেখলুম। আমার বড়ো জায়ের দশা । তিনি নিতান্ত দরদে পড়ে বোনটিকে নিজের কাছে এনেছেন । কিন্তু, যখন দেখলেন স্বামীর অনিচ্ছা, তখন এমনি ভাব করতে লাগলেন, যেন এ তার এক বিষম বালাই, যেন একে দূর করতে পারলেই তিনি বঁাচেন । এই অনাথা বোনটিকে মন খুলে প্রকাশ্যে স্নেহ দেখাবেন, সে সাহস তার হল না । তিনি পতিব্ৰতা । তার এই সংকট দেখে আমার মন আরো ব্যথিত হয়ে উঠল। দেখলুম, বড়ো জা সকলকে একটু বিশেষ করে দেখিয়ে দেখিয়ে বিন্দুর খাওয়াপরার এমনি মোটারকমের ব্যবস্থা করলেন এবং বাড়ির সর্বপ্রকার দাসীবৃত্তিতে তাকে এমনভাবে নিযুক্ত করলেন যে আমার, কেবল দুঃখ নয়, লজ্জা বোধ হল । তিনি সকলের কাছে প্রমাণ করবার জন্যে ব্যস্ত যে, আমাদের সংসারে ফাকি দিয়ে বিন্দুকে ভারি সুবিধাদরে পাওয়া গেছে । ও কাজ দেয় বিস্তর, অথচ খরচের হিসাবে বেজায় সস্তা । আমাদের বড়ো জায়ের বাপের বংশে কুল ছাড়া আর বড়ো কিছু ছিল না- রূপও না, টাকাও না । আমার শ্বশুরের হাতে পায়ে ধরে কেমন করে তোমাদের ঘরে তার বিবাহ হল সে তো সমস্তই জান । S SR | | SR SR