পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৫০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VSO\) S রবীন্দ্র-রচনাবলী তিনি নিজের বিবাহটাকে এ বংশের প্রতি বিষম একটা অপরাধ বলেই চিরকাল মনে জেনেছেন । সেইজন্যে সকল বিষয়েই নিজেকে যতদূর সম্ভব সংকুচিত করে তোমাদের ঘরে তিনি অতি অল্প জায়গা জুড়ে থাকেন । i. কিন্তু, তার এই সাধু দৃষ্টান্তে আমাদের বড়ো মুশকিল হয়েছে। আমি সকল দিকে আপনাকে অত অসম্ভব খাটো করতে পারি নে। আমি যেটাকে ভালো বলে বুঝি আর-কারও খাতিরে সেটাকে মন্দ বলে মেনে নেওয়া আমার কর্ম নয়- তুমিও তার অনেক প্রমাণ পেয়েছ। বিন্দুকে আমি আমার ঘরে টেনে নিলুম। দিদি বললেন, “মেজেবিউ গরিবের ঘরের মেয়ের মাথাটি খেতে বসলেন।”আমি যেন বিষম একটা বিপদ ঘটালুম, এমনি ভাবে তিনি সকলের কাছে নালিশ করে বেড়ালেন । কিন্তু, আমি নিশ্চয় জানি, তিনি মনে মনে বেঁচে গেলেন । এখন দোষের বোঝা আমার উপরেই পড়ল । তিনি বোনকে নিজে যে-ক্সোহ দেখাতে পারতেন না। আমাকে দিয়ে সেই স্নেহটুকু করিয়ে নিয়ে তার মনটা হালকা হল । আমার বড়ো জা বিন্দুর বয়স থেকে দু-চারটে অঙ্ক বাদ দিতে চেষ্টা করতেন । কিন্তু, তার বয়স যে চোদর চেয়ে কম ছিল না, এ কথা লুকিয়ে বললে অন্যায় হত না । তুমি তো জান, সে দেখতে এতই মন্দ ছিল যে পড়ে গিয়ে সে যদি মাথা ভাঙত তবে ঘরের মেজেটার জন্যেই লোকে উদবিগ্ন হত । কাজেই পিতা-মাতার অভাবে কেউ তাকে বিয়ে দেবার ছিল না, এবং তাকে বিয়ে করবার মতো মনের জোরই বা কজন লোকের ছিল । বিন্দু বড়ো ভয়ে ভয়ে আমার কাছে এল । যেন আমার গায়ে তার ছোয়াচ লাগলে আমি সইতে পারব না । বিশ্বসংসারে তার যেন জন্মাবার কোনো শর্ত ছিল না ; তাই সে কেবলই পাশ কাটিয়ে, চোখ এড়িয়ে চলত। তার বাপের বাড়িতে তার খুড়ততো ভাইরা তাকে এমন একটু কোণও ছেড়ে দিতে চায় নি যে-কোণে একটা অনাবশ্যক জিনিস পড়ে থাকতে পারে । অনাবশ্যক আবর্জনা ঘরের আশে-পাশে অনায়াসে স্থান পায়, কেননা মানুষ তাকে ভুলে যায়, কিন্তু অনাবশ্যক মেয়েমানুষ যে একে অনাবশ্যক আবার তার উপরে তাকে ভোলাও শক্ত, সেইজন্যে আঁস্তাকুড়েও তার স্থান নেই। অথচ বিন্দুর খুড়ততো ভাইরা যে জগতে পরমাবশ্যক পদার্থ তা বলবার জো নেই। কিন্তু, তারা বেশ আছে। তাই, বিন্দুকে যখন আমার ঘরে ডেকে আনলুম, তার বুকের মধ্যে কঁাপিতে লাগল। তার ভয় দেখে আমার বড়ো দুঃখ হল । আমার ঘরে যে তার একটুখানি জায়গা আছে, সেই কথাটি আমি অনেক আদর করে তাকে বুঝিয়ে দিলুম। কিন্তু, আমার ঘর শুধু তো আমারই ঘর নয় । কাজেই আমার কাজটি সহজ হল না । দু-চারদিন আমার কাছে থাকতেই তার গায়ে লাল-লাল কী উঠল, হয়তো সে ঘামাচি, নয় তো আর-কিছু হবে । তোমরা বললে বসন্ত । কেননা, ও যে বিন্দু। তোমাদের পাড়ার এক আনাড়ি ডাক্তার এসে বললে, আর দুই-একদিন না গেলে ঠিক বলা যায় না। কিন্তু সেই দুই-একদিনের সবুর সইবে কে । বিন্দু তো তার ব্যামোর লজ্জাতেই মরবার জো হল । আমি বললুম, বসন্ত হয় তো হােক, আমি আমাদের সেই আঁতুড়ঘরে ওকে নিয়ে থাকিব, আর-কাউকে কিছু করতে হবে না । এই নিয়ে আমার উপরে তোমরা যখন সকলে মারমূর্তি ধরেছ, এমন-কি, বিন্দুর দিদিও যখন অত্যন্ত বিরক্তির ভান করে পোড়াকপালি মেয়েটাকে হাসপাতালে পাঠাবার প্রস্তাব করছেন, এমন সময় ওর গায়ের সমস্ত লাল দাগ একদম মিলিয়ে গেল । তোমরা দেখি তাতে আরো ব্যন্ত হয়ে উঠলে । বললে, নিশ্চয়ই বসন্ত বসে গিয়েছে কেননা, ও যে বিন্দু। অনাদরে মানুষ হবার একটা মন্ত গুণ শরীরটাকে তাতে একেবারে অজর অমর করে তোলে । ল্যামো হতেই চায় না- মরার সদর রাস্তাগুলো একেবারেই বন্ধ । রোগ। তাই ওকে ঠাট্টা করে গেল, কিছুই হল না। কিন্তু, এটা বেশ বোঝা গেল, পৃথিবীর মধ্যে সব চেয়ে অকিঞ্চিৎকর মানুষকে আশ্রয় দেওয়াই সব চেয়ে কঠিন ৷ আশ্রয়ের দরকার তার যত বেশি আশ্রয়ের বাধাও তার তেমনি বিষম | আমার সম্বন্ধে বিন্দুর ভয় যখন ভাঙল তখন ওকে আর-এক গেরোয় ধরল। আমাকে এমনি ভালোবাসতে শুরু করলে যে, আমাকে ভয় ধরিয়ে দিলে। ভালোবাসার এরকম মূর্তি সংসারে তো