পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৬১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

5&t V8v) দরকারও খুব ছিল, কিন্তু ভয়ে তার সঙ্গে দেখা পর্যন্ত করিতে গেলাম না । একবার যখন একটা বড়ো হুন্ডির মেয়াদ আসন্ন এমন সময়ে প্ৰসন্ন আসিয়া বলিল, “অখিলবাবুর মেয়ের টাকাটা এবার না লইলে নয় ।” আমি বলিলাম, “ যেরকম দশা সিধা-কাটাও আমার দ্বারা সম্ভব, কিন্তু এ টাকাটা লইতে পারিব না ।” প্ৰসন্ন কহিল, “যখন হইতে তোমার ভরসা গেছে তখন হইতেই কারবারে লোকসান চলিতেছে ! কপাল ঠুকিয়া লাগিলেই কপালের জোরও বাড়ে ।” কিছুতেই রাজি হইলাম না । পরদিন প্ৰসন্ন আসিয়া কহিল, “দক্ষিণ হইতে এক বিখ্যাত মারাঠি গণৎকার আসিয়াছে, তাহার কাছে কুষ্ঠি লইয়া চলো।” সনাতন দত্তর বংশে কুষ্ঠি মিলাইয়া ভাগ্যপরীক্ষা ! দুর্বলতার দিনে মানবপ্রকৃতির ভিতরকার সাবেককেলে বর্বরটা বল পাইয়া উঠে । যাহা দৃষ্ট তাহা যখন ভয়ংকর তখন যাহা অদৃষ্ট তাহাকে বুকে চাপিয়া ধরিতে ইচ্ছা করে । বুদ্ধিকে বিশ্বাস করিয়া কোনো আরাম পাইতেছিলাম না, তাই নিবুদ্ধিতার শরণা লইলাম ; জন্মক্ষণ ও সন-তারিখ লইয়া গনাইতে গেলাম । শুনিলাম, আমি সর্বনাশের শেষ কিনারায় আসিয়া দাড়াইয়াছি। কিন্তু এইবার বৃহস্পতি অনুকুল— এখন তিনি আমাকে কোনো-একটি স্ত্রীলোকের ধানের সাহায্যে উদ্ধার করিয়া অতুল ঐশ্বৰ্য মিলাইয়া দিবেন । ইহার মধ্যে প্ৰসন্নর হাত আছে, এমন সন্দেহ করিতে পারিতাম । কিন্তু সন্দেহ করিতে কোনোমতেই ইচ্ছা হইল না । বাড়ি ফিরিয়া আসিলে প্ৰসন্ন আমার হাতে একখানা বই দিয়া বলিল, “ খোলো দেখি ।” খুলিতেই যে পাতা বাহির হইল তাহাতে ইংরাজিতে লেখা, বাণিজ্যে আশ্চর্য সফলতা । সেইদিনই অনুকে দেখিতে গেলাম । স্বামীর সঙ্গে মফঃস্বলে ফিরিবার সময় বার বার ম্যালেরিয়া জ্বরে পড়িয়া অনুর এখন এমন দশা যে ডাক্তাররা ভয় করিতেছে তাকে ক্ষয়রোগে ধরিয়াছে। কোনো ভালো জায়গায় যাইতে বলিলে সে বলে, “আমি তো আজ বাদে কাল মরিবই, কিন্তু আমার সুবোধের টাকা আমি নষ্ট করিব কেন ।”- এমনি করিয়া সে সুবােধকে ও সুবােধের টাকাটিকে নিজের প্রাণ দিয়া পালন করিতেছে। 瞬 আমি গিয়া দেখিলাম, অনুর রোগটি তাকে এই পৃথিবী হইতে তফাত করিয়া দিয়াছে। আমি যেন তাকে অনেক দূর হইতে দেখিতেছি । তার দেহখানি একেবারে স্বচ্ছ হইয়া ভিতর হইতে একটি আভা বাহির হইতেছে। যা-কিছু স্কুল সমস্ত ক্ষয় করিয়া তার প্রাণটি মৃত্যুর বাহির দরজায় স্বর্গের আলোতে আসিয়া দাড়াইয়াছে। আর, সেই তার করুণ দুটি চোখের ঘন পল্লব । চোখের নীচে কালি পড়িয়া মনে হইতেছে, যেন তার দৃষ্টির উপরে জীবনান্তকালের সন্ধ্যার ছায়া নামিয়া আসিয়াছে। আমার সমস্ত মন স্তব্ধ হইয়া গেল, আজ তাহাকে দেবী বলিয়া মনে হইল । আমাকে দেখিয়া অনুর মুখের উপর একটি শান্ত প্ৰসন্নতা ছড়াইয়া পড়িল । সে বলিল, “কাল রাত্রে আমার অসুখ যখন বাড়িয়াছিল তখন হইতে তোমার কথাই ভাবিতেছি । আমি জানি, আমার আর বেশি দিন নাই। পরশু ভাইফোটার দিন, সেদিন আমি তোমাকে শেষ ভাইফোটা দিয়া যাইব ।” টাকার কথা কিছুই বলিলাম না । সুবোধকে ডাকাইয়া আনিলাম। তার বয়স সাত । চোখদুটি মায়েরই মতো । সমস্তটা জড়াইয়া তার কেমন-একটি ক্ষণিকতার ভাব, পৃথিবী যেন তাকে পুরা পরিমাণ স্তন্য দিতে ভুলিয়া গেছে। কোলে টানিয়া তার কপাল চুম্বন করিলাম। সে চুপ করিয়া আমার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। প্ৰসন্ন জিজ্ঞাসা করিল, “কী হইল।” আমি বলিলাম, “আজ আর সময় হইল না ।” সে কহিল, “মেয়াদের আর নয় দিন মাত্র বাকি ৷”