পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৬২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

w88 রবীন্দ্র-রচনাবলী বলিয়া মনে হইতেছিল না । কিছুকাল হইতে হিসাবপত্র দেখা ছাড়িয়া দিয়াছিলাম। কুল দেখা যাইত না বলিয়া ভয়ে চোখ বুজিয়া থাকিতাম । মরীয়া হইয়া সই করিয়া যাইতাম, বুঝিবার চেষ্টা করিতাম না । ভাইফোটার সকালবেলা একখানা হিসাবের চুম্বক ফর্দ লইয়া জোর করিয়া প্ৰসন্ন আমাকে কারবারের বর্তমান অবস্থাটা বুঝাইয়া দিল । দেখিলাম, মূলধনের সমস্ত তলা একেবারে ক্ষইয়া গেছে। এখন কেবলই ধারের টাকায় জল সেচিয়া না চলিলে নীেকাডুবি হইবে । কৌশলে টাকার কথাটা পাড়িবার উপায় ভাবিতে ভাবিতে ভাইফোটার নিমন্ত্রণে চলিলাম । দিনটা ছিল বৃহস্পতিবার । এখন হতবুদ্ধির তাড়ায় বৃহস্পতিবারকেও ভয় না করিয়া পারি না । যে মানুষ হতভাগা, নিজের বুদ্ধি ছাড়া আর-কিছুকেই না মানিতে তার ভরসা হয় না । যাবার বেলায় মনটা বড়ো খারাপ হইল । অনুর জ্বর বাডিয়াছে ! দেখিলাম, সে বিছানায় শুইয়া । নীচে মেঝের উপর চুপ করিয়া বসিয়া সুবোধ ইংরাজি ছবির কাগজ হইতে ছবি কাটিয়া আটা দিয়া একটা খাতায় আঁটিতেছিল । বারবেল বঁাচাইবার জন্য সময়ের অনেক আগে আসিয়াছিলাম ! কথা ছিল, আমার স্ত্রীকেও সঙ্গে আনিব । কিন্তু অনুর সম্বন্ধে আমার স্ত্রীর মনের কোণে বোধ করি একটুখানি ঈর্ষা ছিল, তাই সে আসিবার সময় ছুতা করিল— আমিও পীড়াপীড়ি করিলাম না । অনু জিজ্ঞাসা করিল, “বউদিদি এলেন না ?” অনু একটু নিশ্বাস ফেলিল, আর কিছু বলিল না । আমার মধ্যে একদিন যেটুকু মাধুর্য দেখা দিয়াছিল সেইটিকে আপনার সোনার আলোয় গলাইয়া শরতের আকাশ সেই রোগীর বিছানার উপর বিছাইয়াছিল । কত কথা আজ উঠিয়া পড়িল । সেই-সব অনেক দিনের অতি ছোটাে কথা আমার আসন্ন সর্বনাশকে ছাড়াইয়া আজ কত বড়ো হইয়া উঠিল । কারবারের হিসােব ভুলিয়া গেলাম । ভাইফোটার খাওয়া খাইলাম। আমার কপালে সেই মরণের যাত্রী দীর্ঘায়ুকামনার ফোটা পরাইয়া আমার পায়ের ধূলা লইল । আমি গোপনে চোখ মুছিলাম । ঘরে আসিয়া বসিলে সে একটি টিনের বাক্স আমার কাছে আনিয়া রাখিল । বলিল, “সুবোধের জন্য এই যা-কিছু এতদিন আগলাইয়া রাখিয়াছি তোমাকে দিলাম, আর সেইসঙ্গে সুবোধকেও তোমার হাতে দিলাম । এখন নিশ্চিন্ত হইয়া মরিতে পারিব।” আমি বলিলাম, “অনু, দোহাই তোমার, টাকা আমি লইব না । সুবোধের দেখাশুনার কোনো ত্রুটি হইবে না, কিন্তু টাকা আর-কারও কাছে রাখিয়ো ।” অনু কহিল, “এই টাকা লইবার জন্য কত লোক হাত পাতিয়া বসিয়া আছে । তুমি কি তাদের হাতেই দিতে বল ?” আমি চুপ করিয়া রহিলাম। অনু বলিল, “একদিন আড়াল হইতে শুনিয়াছি, ডাক্তার বলিয়াছে, সুবোধের যেরকম শরীরের লক্ষণ ওর বেশিদিন বঁাচার আশা নাই ! শুনিয়া অবধি ভয়ে ভয়ে আছি, পাছে আমার মরিতে দেরি হয় । আজ অন্তত আশা লইয়া মরিব যে, ডাক্তারের কথা ভুল হইতেও পারে । সাতচল্লিশ হাজার টাকা কোম্পানির কাগজে জমিয়াছে- আরো কিছু এদিকে ওদিকে আছে। ঐ টাকা হইতে সুবোধের পথ্য ও চিকিৎসা ভালো করিয়াই চলিতে পরিবে । আর যদি ভগবান অল্প বয়সেই উহাকে টানিয়া লন, তবে এই টাকা উহার নামে একটা কোনো ভালো কাজে লাগাইয়ো ।” আমি কহিলাম, “অনু, আমাকে তুমি যত বিশ্বাস কর আমি নিজেকে তত বিশ্বাস করি না ।” শুনিয়া অনু একটুমাত্র হাসিল । আমার মুখে এমন কথা মিথ্যা বিনয়ের মতো শোনায় । বিদায়কালে অনু বাক্স খুলিয়া কোম্পানির কাগজ ও কয়েক কেতা নোট বুঝাইয়া দিল । তার উইলে দেখিলাম লেখা আছে, অপুত্ৰক ও নাবালক অবস্থায় সুবোধের মৃত্যু হইলে আমিই সম্পত্তির