পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৬৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

test ○8Q উত্তরাধিকারী । আমি বলিলাম, “আমার স্বার্থের সঙ্গে তোমার সম্পত্তি কেন এমন করিয়া জড়াইলে ।” অনু কহিল, “আমি যে জানি, আমার ছেলের স্বার্থে তোমার স্বাৰ্থ কোনোদিন বাধিবে না।” আমি কহিলাম, “কোনো মানুষকেই এতটা বিশ্বাস করা কাজের দস্তুর নয় ।” অনু কহিল, “আমি তোমাকে জানি, ধর্মকে জানি, কাজের দস্তুর বুঝিবার আমার শক্তি নাই ।” বাক্সের মধ্যে গহনা ছিল, সেগুলি দেখাইয়া সে বলিল, “সুবোধ যদি বঁাচে ও বিবাহ করে, তবে বউমাকে এই গহনা ও আমার আশীৰ্বাদ দিয়ো । আর এই পান্নার কণ্ঠীটি বউদিদিকে দিয়া বলিয়ো, আমার মাথার দিব্য, তিনি যেন গ্ৰহণ করেন ।” এই বলিয়া অনু যখন ভূমিষ্ঠ হইয়া আমাকে প্ৰণাম করিল। তার দুই চােখ জলে ভরিয়া উঠিল । উঠিয়া দাড়াইয়া তাড়াতাড়ি সে মুখ ফিরাইয়া চলিয়া গেল । এই আমি তার শেষ প্ৰণাম পাইয়াছি। ইহার দুই দিন পরেই সন্ধ্যার সময় হঠাৎ নিশ্বাস বন্ধ হইয়া তার মৃত্যু হইল— আমাকে খবর দিবার ञ्श °ळ ऴ ।। ভাইফোটার নিমন্ত্রণ সারিয়া, টিনের বাক্স হাতে, গাড়ি হইতে বাড়ির দরজায় যেমনি নামিলাম দেখি, প্ৰসন্ন অপেক্ষা করিয়া আছে । জিজ্ঞাসা করিল, “দাদা, খবর ভালো তো ?” আমি বলিলাম, “এ টাকায় কেহ হাত দিতে পরিবে না ।” প্ৰসন্ন কহিল, “কিন্তু-” আমি বলিলাম, “ সে জানি না- যা হয় তা হােক, এ টাকা আমার ব্যবসায়ে লাগিবে না ।” প্ৰসন্ন বলিল, “তবে তোমার আস্ত্যেষ্টিসৎকারে লাগিবে ।” অনুর মৃত্যুর পর সুবোধ আমার বাড়িতে আসিয়া আমার ছেলে নিত্যধনকে সঙ্গী পাইল । যারা গল্পের বই পড়ে মন করে, মানুষের মনের বড়ো বড়ো পরিবর্তন ধীরে ধীরে ঘটে । ঠিক উলটা । টিকার আগুন ধরিতে সময় লাগে। কিন্তু বড়ো বড়ো আগুন হুহু করিয়া ধরে । আমি এ কথা যদি বলি যে, অতি অল্প সময়ের মধ্যে সুবোধের উপর আমার মনের একটা বিদ্বেষ দেখিতে দেখিতে বাড়িয়া উঠিল, তবে সবাই তার বিস্তারিত কৈফিয়ত চাহিবে । সুবোধ অনাথ, সে বড়ো ক্ষীণপ্ৰাণ, সে দেখিতেও সুন্দর, সকলের উপরে সুবোধের মা স্বয়ং অনু- কিন্তু তার কথাবার্তা, চলাফেরা, খেলাধুলা, সমস্তই যেন আমাকে দিনরাত খোচা দিতে লাগিল । 乌 আসল, সময়টা বড়ো খারাপ পড়িয়াছিল । সুবোধের টাকা কিছুতেই লইব না পণ ছিল, অথচ ও টাকাটা না লইলে নয় এমনি অবস্থা । শেষকালে একদিন মহা বিপদে পড়িয়া কিছু লইলাম । ইহাতে আমার মনের কল এমনি বিগড়াইয়া গেল যে, সুবোধের কাছে মুখ-দেখানো আমার দায় হইল । প্রথমটা উহাকে এড়াইতে থাকিলাম, তার পর উহার উপরে বিষম রাগিতে আরম্ভ করিলাম । রাগিব।ার প্রথম উপলক্ষ হইল উহার স্বভাব । আমি নিজে ব্যস্তবাগীশ, সব কাজ তড়িঘড়ি করা আমার অভ্যাস । কিন্তু সুবোধের কী একরকমের ভাব, উহাকে প্রশ্ন করিলে হঠাৎ যেন উত্তর করিতেই পারে না- যেখানে সে আছে সেখানে যেন সে নাই, যেন সে আর কোথাও । রাস্তার ধারের জানলার গরাদে ধরিয়া ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাইয়া দেয় ; কী দেখে, কী ভাবে, তা সেই জানে । আমার এটা অসহ্য বোধ হয় । সুবোধ বহুকাল হইতে রুগণ মায়ের কাছে মানুষ, সমবয়সী খেলার সঙ্গী কেউ ছিল নাতাই সে বরাবর আপনার মনকে লইয়াই আপনি খেলা করিয়াছে। এই সব ছেলের মুশকিল। এই যে, ইহারা যখন শোক পায় তখন ভালো করিয়া কঁদিতেও জানে না, শোক ভুলিতেও জানে না । এইজন্যই সুবোধকে ডাকিলে হঠাৎ সাড়া পাওয়া যাইত না, এবং কাজ করিতে বলিলে সে ভুলিয়া যাইত । তার জিনিসপত্র সে কেবলই হারাইত, তাহা লইয়া বকিলে চুপ করিয়া মুখের দিকে চাহিয়া থাকিত- যেন সেই চাহিয়া থাকাই তার কান্না । আমি বলিতে লাগিলাম, এর দৃষ্টান্ত যে আমার ছেলের পক্ষে বড়ো খারাপ। আবার মুশকিল। এই যে, ইহাকে দেখিয়া অবধি নিত্যর ইহাকে ভারি ভালো লাগিয়াছে ; তার প্রকৃতি সম্পূর্ণ অন্যরকম বলিয়াই ইহার প্রতি টানও যেন তার বেশি হইল।