পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৬৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

sites «Օ3Գ উঠাইয়া দিতে হয়- চলিবার সময় যেন পায়ে পায়ে জড়াইয়া চলে । আমি সুবোধকে বলিতাম, জন্মকুড়ে, কুঁড়েমির মহামহােপাধ্যায়। সে লজ্জিত হইয়া চুপ করিয়া থাকিত । একদিন তাকে বলিয়াছিলাম, “বল দেখি প্রশান্ত মহাসাগরের পরে কোন মহাসাগর।” যখন সে জবাব দিতে পারিল না। আমি বলিলাম, “সে হচ্ছে তুমি, আলস্যমহাসাগর।” পারতপক্ষে সুবোধ কোনোদিন আমার কাছে কঁদে না, কিন্তু সেদিন তার চােখ দিয়া ঝরঝর করিয়া জল পড়তে লাগিল। সে মার গালি সব সহিতে পারিত, কিন্তু বিদ্রুপ তার মর্মে গিয়া বাজিত । বেলা গেল । রাত হইল । ঘরে কেহ বাতি দিল না । আমি ডাকাডাকি করিলাম, কেহ সাড়া দিল না । বাড়িসুদ্ধ সকলের উপর আমার রাগ হইল। তার পরে হঠাৎ আমার সন্দেহ হইল, হয়তো প্ৰসন্ন সুদের টাকা সুবোধের হাতে দিয়াছে, সুবোধ তাই লইয়া পালাইয়াছে। আমার ঘরে সুবোধের যে আরাম ছিল না সে আমি জানিতাম । ছেলেবেলা হইতে আরাম জিনিসটাকে অন্যায় বলিয়াই জানি, বিশেষত ছোটো ছেলের পক্ষে । তাই এ সম্বন্ধে আমার মনে কোনো পরিতাপ ছিল না । কিন্তু তাই বলিয়া সুবোধ যে টাকা লইয়া পালাইয়া যাইতে পারে। ইহা চিন্তা করিয়া আমি তাকে কপট অকৃতজ্ঞ বলিয়া মনে মনে গালি দিতে লাগিলাম। এই বয়সেই চুরি আরম্ভ করিল, ইহার গতি কী হইবে । আমার কাছে থাকিয়া, আমাদের বাড়িতে বাস করিয়াও ইহার এমন শিক্ষা হইল কী করিয়া । সুবোধ যে টাকা চুরি করিয়া পালাইয়াছে। এ-সম্বন্ধে আমার মনে কোনো সন্দেহ রহিল না । ইচ্ছা হইল, পশ্চাতে ছুটিয়া তাকে যেখানে পাই ধরিয়া আনি, এবং আপাদমস্তক একবার কবিয়া প্ৰহার করি । এমন সময়ে আমার অন্ধকার ঘরে সুবোধ আসিয়া প্ৰবেশ করিল। তখন আমার এমন রাগ হইয়াছে যে চেষ্টা করিয়াও আমার কণ্ঠ দিয়া কথা বাহির হইল না । সুবোধ বলিল, “টাকা পাই নাই ।” আমি তো সুবোধকে টাকা আনিতে বলি নাই, তবে সে কেন বলিল “টাকা পাই নাই । নিশ্চয় টাকা পাইয়া চুরি করিয়াছে- কোথাও লুকাইয়াছে। এই সমস্ত ভালোমানুষ ছেলেরাই মিটমিটে শয়তান । আমি বহু কষ্টে কণ্ঠ পরিষ্কার করিয়া বলিলাম, “টাকা বাহির করিয়া দে ।” সেও উদ্ধত হইয়া বলিল, “না, দিব না, তুমি কী করিতে পার করো ।” আমি আর কিছুতেই আপনাকে সামলাইতে পারিলাম না । হাতের কাছে লাঠি ছিল, সজোরে তার মাথা লক্ষ্য করিয়া মারিলাম । সে আছাড় খাইয়া পড়িয়া গেল । তখন আমার ভয় হইল । নাম ধরিয়া ডাকিলাম, সে সাড়া দিল না । কাছে গিয়া যে দেখিব আমার সে শক্তি রহিল না । কোনো মতেই উঠিতে পারিলাম না । হাতড়াইতে গিয়া দেখি, জাজিম ভিজিয়া গেছে । এ যে রক্ত ! ক্রমে রক্ত ব্যাপ্ত হইতে লাগিল । ক্রমে আমি যেখানে ছিলাম তার চারি দিক রক্তে ভিজিয়া উঠিল । আমার খোলা জানলার বাহির হইতে সন্ধ্যাতারা দেখা যাইতেছিল ; আমি তাড়াতাড়ি চোখ ফিরাইয়া লইলামআমার হঠাৎ কেমন মনে হইল, সন্ধ্যাতারাটি ভাইফোটার সেই চন্দনের ফোটা । সুবোধের উপর আমার এতদিনকার যে অন্যায় বিদ্বেষ ছিল সে কোথায় এক মুহুর্তে ছিন্ন হইয়া গেল। সে যে অনুর হৃদয়ের ধন ; মায়ের কোল হইতে ভ্ৰষ্ট হইয়া সে যে আমার হৃদয়ে পথ খুঁজিতে আসিয়াছিল। আমি এ কী করিলাম ! এ কী করিলাম ! ভগবান আমাকে এ কী বুদ্ধি দিলে ! আমার টাকার কী দরকার ছিল । আমার সমস্ত কারবার ভাসাইয়া দিয়া সংসারে কেবল এই রুগণ বালকটির কাছে যদি ধর্ম রাখিতাম তাহা হইলে যে আমি রক্ষা পাইতাম । ক্রমে ভয় হইতে লাগিল পাছে কেহ আসিয়া পড়ে, পাছে ধরা পড়ি । প্ৰাণপণে ইচ্ছা করিতে লাগিলাম কেহ যেন না আসে, আলো যেন না আনে—এই অন্ধকার যেন মুহুর্তের জন্য না ঘোচে, যেন কাল সূর্য না ওঠে, যেন বিশ্বসংসার একেবারে সম্পূর্ণ মিথ্যা হইয়া এমনিতরো নিবিড় কালো হইয়া আমাকে আর এই ছেলেটিকে চিরদিন ঢাকিয়া রাখে । পায়ের শব্দ শুনিলাম। মনে হইল, কেমন করিয়া পুলিস খবর পাইয়াছে। কী মিথ্যা কৈফিয়ত দিব তাড়াতাড়ি সেইটো ভাবিয়া লইতে চেষ্টা করিলাম, কিন্তু মন একেবারেই ভাবিতে পারিল না । \