পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৭০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VOD SR রবীন্দ্র-রচনাবলী আকাশের তারাগুলি যেন করুণা-বিগলিত জলের মতো জ্বলজ্বল করিতে লাগিল। যে জীবন আজ বিদায় লইবার পথে আসিয়া দাড়াইয়াছে যতীন তাহাকে মনে মনে কৃতজ্ঞতার প্রণাম করিল- এবং সম্মুখে মৃত্যু আসিয়া অন্ধকারের ভিতর হইতে যে দক্ষিণ হাত বাড়াইয়া দিয়াছে যতীন স্নিগ্ধ বিশ্বাসের সহিত তাহার উপরে আপনার রোগব্লকান্ত হাতটি রাখিল । একবার নিশ্বাস ফেলিয়া, একটুখানি উসখুসি করিয়া যতীন বলিল, “মাসি, মণি যদি জেগেই থাকে তা হলে একবার যদি তাকে-” “এখনি ডেকে দিচ্ছি, বাবা ।” “আমি বেশিক্ষণ তাকে এ ঘরে রাখতে চাই নে- কেবল পাচ মিনিট- দুটাে-একটা কথা যা दळणीबद्ध उठू-” মাসি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া মণিকে ডাকিতে আসিলেন । এদিকে যতীনের নাড়ী দ্রুত চলিতে লাগিল ৷ যতীন জানে, আজ পর্যন্ত সে মণির সঙ্গে ভালো করিয়া কথা জমাইতে পারে নাই। দুই যন্ত্র দুই সুরে বাধা, একসঙ্গে আলাপ চলা বড়ো কঠিন । মণি তাহার সঙ্গিনীদের সঙ্গে অনর্গল বকিতেছে, হাসিতেছে, দূর হইতে তাঁহাই শুনিয়া যতীনের মন কতবার ঈর্ষায় পীড়িত হইয়াছে। যতীন নিজেকেই দোষ দিয়াছে- সে কেন অমন সামান্য যাহ-তাহা লইয়া কথা কহিতে পারে না । পারে না যে তাহাও তো নহে, নিজের বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে যতীন সামান্য বিষয় লইয়াই কি আলাপ করে না । কিন্তু পুরুষের যাহা-তােহা তো মেয়েদের যাহ-তাহার সঙ্গে ঠিক মেলে না । বড়ো কথা একলাই একটানা বলিয়া যাওয়া চলে, অন্য পক্ষ মন দিল কি না খেয়াল না করিলেই হয়, কিন্তু তুচ্ছ কথায় নিয়ত দুই পক্ষের যোগ থাকা চাই ; বঁাশি একাই বাজিতে পারে, কিন্তু দুইয়ের মিল না থাকিলে করতালের খচমচ জমে না । এইজন্য কত সন্ধ্যাবেলায় যতীন মণির সঙ্গে যখন খোলা বারান্দায় মাদুর পাতিয়া বসিয়াছে, দুটা-চারটে টানাবোনা কথার পরেই কথার সূত্র একেবারে ছিড়িয়া ফাক হইয়া গেছে ; তাহার পরে সন্ধ্যার নীরবতা যেন লজ্জায় মরিতে চাহিয়াছে। যতীন বুঝিতে পারিয়াছে, মণি পালাইতে পারিলে বঁাচে ; মনে মনে কামনা করিয়াছে, এখনই কোনো—একজন তৃতীয় ব্যক্তি যেন আসিয়া পড়ে । কেননা, দুই জনে কথা কহা কঠিন, তিন জনে সহজ । মণি আসিলে আজ কেমন করিয়া কথা আরম্ভ করিবে, যতীন তাহাই ভাবিতে লাগিল । ভাবিতে গেলে কথাগুলো কেমন অস্বাভাবিক রকম বড়ো হইয়া পড়ে- সে-সব কথা চলিবে না । যতীনের আশঙ্কা হইতে লাগিল, আজকের রাত্ৰে পাচ মিনিটও ব্যর্থ হইবে । অথচ, তাহার জীবনে এমনতরো নিরালা পাচ মিনিট আর কাঁটাই বা বাকি আছে । W “একি, বউ, কোথাও যাচ্ছ না কি ৷” “সীতারামপুরে যাব।” “সে কী কথা । কার সঙ্গে যাবে ।” “অনাথ নিয়ে যাচ্ছে ।” “লক্ষ্মী মা আমার, তুমি যেয়ো, আমি তোমাকে বারণ করব না, কিন্তু আজ নয় ।” “টিকিট কিনে গাড়ি রিজার্ভ করা হয়ে গেছে।” “তা হােক, ও লোকসান গায়ে সইবে- তুমি কাল সকালেই চলে যেয়ো- আজ যেয়ে না।” “মাসি, আমি তোমাদের তিথি বার মানি নে, আজ গেলে দোষ কী ।” “যতীন তোমাকে ডেকেছে, তোমার সঙ্গে তার একটু কথা আছে।” “বেশ তো, এখনো একটু সময় আছে, আমি তাকে বলে আসছি।”