পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৭৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ VVS জিতিবেন, এ একেবারে ধরা কথা । এইজন্য আমাদের অভাব না থাকিলেও এবং অন্য পক্ষের অভাব কঠিন হইলেও জিতিব, আমাদের সংসারের এই জেদ- ইহাতে যে বীচুক আর যে মরুক । গায়ে-হলুদ অসম্ভব রকম ধুম করিয়া গেল। বাহক এত গেল যে তাহার আদম-সুমারি করিতে হইলে কেরানি রাখিতে হয় । তাহাদিগকে বিদায় করিতে অপর পক্ষকে যে নাকাল হইতে হইবে, সেই কথা স্মরণ করিয়া মামার সঙ্গে মা একযোগে বিস্তার হাসিলেন । ব্যান্ড, বাঁশি, শখের কন্সার্ট প্রভৃতি যেখানে যত প্রকার উচ্চ শব্দ আছে সমস্ত এক-সঙ্গে মিশাইয়া বর্বর কোলাহলের মত্তহস্তী দ্বারা সংগীত-সরস্বতীর পদ্মবন দলিত বিদলিত করিয়া, আমি তো বিবাহ-বাড়িতে গিয়া উঠিলাম। আংটিতে হারেতে জরি-জহরাতে আমার শরীর যেন গহনার দােকান নিলামে চড়িয়াছে বলিয়া বোধ হইল। তঁহাদের ভাবী জামাইয়ের মূল্য কত সেটা যেন কতক পরিমাণে সর্বাঙ্গে স্পষ্ট করিয়া লিখিয়া, ভাবী শ্বশুরের সঙ্গে মোকাবিলা করিতে চলিয়াছিলাম । মামা বিবাহ-বাড়িতে ঢুকিয়া খুশি হইলেন না । একে তো উঠানটাতে বরযাত্রীদের জায়গা সংকুলান হওয়াই শক্ত, তাহার পরে সমস্ত আয়োজন নিতান্ত মধ্যম রকমের । ইহার পরে শম্ভুনাথবাবুর ব্যবহারটাও নেহাত ঠাণ্ডা । তার বিনয়টা অজস্র নয়। মুখে তো কথাই নাই। কোমরে চাদর বাধা, গলাভাঙা, টাকপড়া, মিসকালো এবং বিপুল শরীর তীর একটি উকিল বন্ধু যদি নিয়ত হাত জোড় করিয়া, মাথা হেলাইয়া, নম্রতার স্মিতহাস্যে ও গদগদ বচনে কন্সার্ট পাটির করতাল-বাজিয়ে হইতে শুরু করিয়া বরাকর্তাদের প্রত্যেককে বার বার প্রচুররাপে অভিষিক্ত করিয়া না দিতেন তবে গোড়াতেই একটা এসপার-ওসপার হইত। আমি সভায় বসিবার কিছুক্ষণ পরেই মামা শঙুনাথবাবুকে পাশের ঘরে ডাকিয়া লইয়া গেলেন । কী কথা হইল জানি না, কিছুক্ষণ পরেই শম্ভুনাথবাবু আমাকে আসিয়া বলিলেন, “বাবাজি, একবার এই দিকে আসতে হচ্ছে ।” ব্যাপারখানা। এই - সকলের না হউক, কিন্তু কোনো কোনো মানুষের জীবনের একটা-কিছু লক্ষ্য থাকে । মামার একমাত্র লক্ষ্য ছিল, তিনি কোনোমতেই কারও কাছে ঠকিবেন না । তার ভয়, তার বেহাই তাকে গহনায় ফাকি দিতে পারেন- বিবাহকার্য শেষ হইয়া গেলে সে ফকির আর প্রতিকার চলিবে না। বাড়িভাড়া, সওগাদ, লোকবিদায় প্রভৃতি সম্বন্ধে যেরকম টানাটানির পরিচয় পাওয়া গেছে তাহাতে মামা ঠিক করিয়াছিলেন, দেওয়া-থোওয়া সম্বন্ধে এ লোকটির শুধু মুখের কথার উপর ভর করা চলিবে না । সেইজন্য বাড়ির স্যাকরাকে সুদ্ধ সঙ্গে আনিয়াছিলেন । পাশের ঘরে গিয়া দেখিলাম, মামা এক তক্তপোশে এবং স্যাকরা তাহার দাড়িপাল্লা কষ্টিপাথর প্রভৃতি লইয়া মেজেয় বসিয়া আছে। শদ্ভুনাথবাবু আমাকে বলিলেন, “তোমার মামা বলিতেছেন, বিবাহের কাজ শুরু হইবার আগেই তিনি কনের সমস্ত গহনা যাচাই করিয়া দেখিবেন, ইহাতে তুমি কী বল ।” আমি মাথা হেঁট করিয়া চুপ করিয়া রহিলাম । মামা বলিলেন, “ও আবার কী বলিবে । আমি যা বলিব তাই হইবে ।” শদ্ভুনাথবাবু আমার দিকে চাহিয়া কহিলেন, “সেই কথা। তবে ঠিক ? উনি যা বলিবেন তাই হইবে ? এ সম্বন্ধে তোমার কিছুই বলিবার নাই ?” আমি একটু ঘাড়-নাড়ার ইঙ্গিতে জানাইলাম, এ-সব কথায় আমার সম্পূর্ণ অনধিকার । আন্ধা। তবে বােসে, মেয়ের গা হইতে সমস্ত গহনা খুলিয়া আনিতেছি ” এই বলিয়া তিনি মামা বলিলেন, “অনুপম এখানে কী করিবে । ও সভায় গিয়া বসুক ।” শম্ভুনাথ বলিলেন, “না, সভায় নয়, এখানেই বসিতে হইবে।” কিছুক্ষণ পরে তিনি একখানা গামছায় বাধা গহনা আনিয়া তক্তপোশের উপর মেলিয়া ধরিলেন । সুতু শুধু পিতামহীদের আমলের গহনা— হাল ফ্যাশনের সৃদ্ধ কাজ নয়— যেমন মােটা,