পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৮১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Neo VV) করিয়া, বরযান্ত্রের দল দক্ষযজ্ঞের পালা সারিয়া বাহির হইয়া গেল । বাড়ি ফিরিবার সময় ব্যান্ড রসনাচৌকি ও কন্সার্ট একসঙ্গে বাজিল না এবং অভ্রের কাড়গুলো আকাশের তারার উপর আপনাদের কর্তব্যের বরাত দিয়া কোথায় যে মহানির্বাণ লাভ করিল সন্ধান পাওয়া গেল না । VO) বাড়ির সকলে তো রাগিয়া আগুন । কন্যার পিতার এত গুমার ! কলি যে চারপোয়া হইয়া আসিল ! সকলে বলিল, “দেখি, মেয়ের বিয়ে দেন কেমন করিয়া ।” কিন্তু মেয়ের বিয়ে হইবে না, এ ভয় যার মনে নাই তার শাস্তির উপায় কী । ২৯ সমস্ত বাংলাদেশের মধ্যে আমিই একমাত্র পুরুষ যাহাকে কন্যার বাপ বিবাহের আসর হইতে নিজে ফিরাইয়া দিয়াছে। এতবড়ো সৎপাত্রের কপালে এতবড়ো কলঙ্কের দাগ কোন নষ্টগ্রহ এত আলো জ্বালাইয়া, বাজনা বাজাইয়া, সমারোহ করিয়া, আঁকিয়া দিল ? বরযাত্ররা এই বলিয়া কপাল চাপড়াইতে লাগিল যে, “বিবাহ হইল না। অথচ আমাদের ফাকি দিয়া খাওয়াইয়া দিল- পাকযন্ত্রটাকে সমস্ত অন্নসুদ্ধ সেখানে টান মারিয়া ফেলিয়া দিয়া আসিতে পারিলে তবে আফসোস মিটিত ।” “বিবাহের চুক্তিভঙ্গ ও মানহানির দাবিতে নালিশ করিব বলিয়া মামা অত্যন্ত গোল করিয়া বেড়াইতে লাগিলেন । হিতৈষীরা বুঝাইয়া দিল, তাহা হইলে তামাশার যেটুকু বাকি আছে তাহা পুরা হইবে । বলা বাহুল্য, আমিও খুব রাগিয়াছিলাম। কোনো গতিকে শম্ভুনাথ বিষম জব্দ হইয়া আমাদের পায়ে ধরিয়া আসিয়া পড়েন, গোফের রেখায় তা দিতে দিতে এইটেই কেবল কামনা করিতে লাগিলাম । কিন্তু, এই আক্রোশের কালো রঙের স্রোতের পাশাপাশি আর-একটা স্রোত বহিতেছিল যেটার রঙ একেবারেই কালো নয় । সমস্ত মন যে সেই অপরিচিতার পানে ছুটিয়া গিয়াছিল— এখনো যে তাহাকে কিছুতেই টানিয়া ফিরাইতে পারি না। দেয়ালটুকুর আড়ালে রহিয়া গেল গো । কপালে তার চন্দন আঁকা, গায়ে তার লাল শাড়ি, মুখে তার লজ্জাররক্তিমা; হৃদয়ের ভিতরে কী যে তা কেমন করিয়া বলিব । আমার কল্পলোকের কল্পলতাটি বসন্তের সমস্ত ফুলের ভার আমাকে নিবেদন করিয়া দিবার জন্য নত হইয়া পড়িয়াছিল । হাওয়া আসে, গন্ধ পাই, পাতার শব্দ শুনি- কেবল আর একটিমাত্র পা-ফেলার অপেক্ষা- এমন সময়ে সেই এক পদক্ষেপের দূরত্বটুকু এক মুহুর্তে অসীম হইয়া উঠিল ! এতদিন যে প্রতি সন্ধ্যায় আমি বিনুদার বাড়িতে গিয়া তাহাকে অস্থির করিয়া তুলিয়াছিলাম । বিনুদার বর্ণনার ভাষা অত্যন্ত সংকীর্ণ বলিয়াই তার প্রত্যেক কথাটি স্ফুলিঙ্গের মতো আমার মনের মাঝখানে আগুন জ্বালিয়া দিয়াছিল। বুঝিয়েছিলাম, মেয়েটির রূপ বড়ো আশ্চর্য, কিন্তু না দেখিলাম তাহাকে চোখে, না দেখিলাম তার ছবি ; সমস্তই অস্পষ্ট হইয়া রহিল ; বাহিরে তো সে ধরা দিলেই না, তাহাকে মনেও আনিতে পারিলাম না- এইজন্য মন সেদিনকার সেই বিবাহসভার দেয়ালটার বাহিরে ভূতের মতো দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বেড়াইতে লাগিল । হরিশের কাছে শুনিয়াছি, মেয়েটিকে আমার ফোটোগ্রাফ দেখানো হইয়াছিল । পছন্দ করিয়াছে বৈকি । না করিবার তো কোনো কারণ নাই । আমার মন বলে, সে ছবি তার কোনো-একটি বাক্সের মধ্যে লুকানো আছে। একলা ঘরে দরজা বন্ধ করিয়া এক-একদিন নিরালা দুপুরবেলায় সে কি সেটি খুলিয়া দেখে না। যখন কুঁকিযা পড়িয়া দেখে তখন ছবিটির উপরে কি তার মুখের দুই ধার দিয়া এলোচুল আসিয়া পড়ে না। হঠাৎ বাহিরে কারও পায়ের শব্দ পাইলে সে কি তাড়াতাড়ি তার সুগন্ধ আঁচলের মধ্যে ছবিটিকে লুকাইয়া ফেলে না । দিন যায় । একটা বৎসর গেল । মামা তো লাজায় বিবাহসম্বন্ধের কথা তুলিতেই পারেন না । মার ইচ্ছা ছিল, আমার অপমানের কথা যখন সমাজের লোকে ভুলিয়া যাইবে তখন বিবাহের চেষ্টা দেখিবেন । S SR | SR 8