পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৮৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VO V9 N2 রবীন্দ্র-রচনাবলী কিছুমাত্র ছিল না- ছােটােদের সঙ্গে সে অনায়াসে এবং আনন্দে ছোটাে হইয়া গিয়াছিল। সঙ্গে কতকগুলি ছবিওয়ালা ছেলেদের গল্পের বই- তাহারই কোন একটা বিশেষ গল্প শোনাইবার জন্য মেয়েরা তাহাকে ধরিয়া পড়িল । এ গল্প নিশ্চয় তারা বিশ-পঁচিশ বার শুনিয়াছে । মেয়েদের কেন যে এত আগ্রহ তাহা বুঝিলাম । সেই সুধাকষ্ঠের সোনার কাঠিতে সকল কথা যে সোনা হইয়া ওঠে । মেয়েটির সমস্ত শরীর মন যে একেবারে প্রাণে ভরা, তার সমস্ত চলায় বলায় সম্পর্শে প্ৰাণ ঠিকারিয়া ওঠে । তাই মেয়েরা যখন তার মুখে গল্প শোনে তখন, গল্প নয়, তাহাকেই শোনে ; তাহাদের হৃদয়ের উপর প্রাণের ঝরনা ঝরিয়া পড়ে । তার সেই উদ্ভাসিত প্ৰাণ আমার সেদিনকার সমস্ত সূর্যকিরণকে সজীব করিয়া তুলিল ; আমার মনে হইল, আমাকে যে-প্রকৃতি তাহার আকাশ দিয়া বেষ্টন করিয়াছে সে ঐ তরুণীরই অক্লান্ত অম্লান প্ৰাণের বিশ্বব্যাপী বিস্তার। —পরের স্টেশনে পৌঁছিতেই খাবারওয়ালাকে ডাকিয়া সে খুব খানিকটা চীনা-মুঠ কিনিয়া লইল, এবং মেয়েদের সঙ্গে মিলিয়া নিতান্ত ছেলেমানুষের মতো করিয়া কলহাস্য করিতে করিতে অসংকোচে খাইতে লাগিল । আমার প্রকৃতি যে জাল দিয়া বেড়া- আমি কেন বেশ সহজে হাসিমুখে মেয়েটির কাছে এই চােনা একমুঠ চাহিয়া লইতে পারিলাম না । হাত বাড়াইয়া দিয়া কেন আমার লোভ স্বীকার করিলাম না । মা ভালো-লাগা এবং মন্দ-লাগার মধ্যে দোমনা হইয়া ছিলেন । গাড়িতে আমি পুরুষমানুষ, তবু ইহার কিছুমাত্র সংকোচ নাই, বিশেষত এমন লোভীর মতো খাইতেছে, সেটা ঠিক তার পছন্দ হইতেছিল না ; অথচ ইহাদের বেহায়া বলিয়াও তার ভ্ৰম হয় নাই । তার মনে হইল, এ মেয়ের বয়স হইয়াছে কিন্তু শিক্ষা হয় নাই । মা হঠাৎ কারও সঙ্গে আলাপ করিতে পারেন না । মানুষের সঙ্গে দূরে দূরে থাকাই তার অভ্যাস । এই মেয়েটির পরিচয় লইতে তার খুব ইচ্ছা, কিন্তু স্বাভাবিক বাধা কাটাইয়া উঠিতে পারিতেছিলেন না । এমন সময় গাড়ি একটা বড়ো স্টেশনে আসিয়া থামিল । সেই জেনারেল-সাহেবের একদল অনুসঙ্গী এই স্টেশন হইতে উঠিবার উদ্যোগ করিতেছে । গাড়িতে কোথাও জায়গা নাই । বার বার আমাদের গাড়ির সামনে দিয়া তারা ঘুরিয়ে গেল। মা তো ভয়ে আড়ষ্ট, আমিও মনের মধ্যে শান্তি পাইতেছিলাম না । গাড়ি ছাড়িবার অল্পকাল পূর্বে একজন দেশী রেলোয়ে কর্মচারী, নাম-লেখা দুইখানা টিকিট গাড়ির দুই বেঞ্চের শিয়রের কাছে লটকাইয়া দিয়া আমাকে বলিল, “এ গাড়ির এই দুই বেঞ্চ আগে হইতেই দুই সাহেব বিজাৰ্ভ করিয়াছেন, আপনাদিগকে অন্য গাড়িতে যাইতে হইবে।” আমি ভূতাড়াতাড়ি বাস্ত হইয়া পাড়াইয়া উঠিলাম। মেয়েট হিন্দিতে বলল, "না, আমরা গাড়ি छेद। नां ।” সে লোকটি রোখা করিয়া বলিল, “না ছাডিয়া উপায় নাই ।” কিন্তু মেয়েটির চলিষ্ণুতার কোনো লক্ষণ না দেখিয়া সে নামিয়া গিয়া ইংরেজ স্টেশন-মাস্টারকে ডাকিয়া আনিল । সে আসিয়া আমাকে বলিল, “আমি দুঃখিত, কিন্তু-” শুনিয়া আমি "কুলি কুলি’ করিয়া ডাক ছাড়িতে লাগিলাম। মেয়েটি উঠিয়া দুই চক্ষে অগ্নিবর্ষণ করিয়া বলিল, “না, আপনি যাইতে পারবেন না, যেমন আছেন বসিয়া থাকুন।” বলিয়া সে দ্বারের কাছে দাড়াইয়া স্টেশন-মাস্টারকে ইংরেজি ভাষায় বলিল, “এ গাড়ি আগে হইতে রিজার্ভ করা, এ কথা মিথ্যা কথা ।” বলিয়া নাম-লেখা টিকিট খুলিয়া প্ল্যাটফর্মে ষ্টুড়িয়া ফেলিয়া দিল । ইতিমধ্যে আর্দালি-সমেত ইউনিফর্ম-পরা সাহেব দ্বারের কাছে আসিয়া দাডাইয়াছে। গাডিতে সে তার আসবাব উঠাইবার জন্য আর্দালিকে প্রথমে ইশারা করিয়াছিল। তাহার পরে মেয়েটির মুখে তাকাইয়া, তার কথা শুনিয়া, ভাব দেখিয়া স্টেশন-মাস্টারকে একটু স্পর্শ করিল এবং তাঁহাকে আড়ালে লইয়া গিয়া কী কথা হইল জানি না। দেখা গেল, গাড়ি ছাড়িবার সময় অতীত হইলেও আর-একটা গাড়ি জুড়িয়া তবে ট্রেন ছাড়িল। মেয়েটি তার দলবল লইয়া আবার একপত্তন চানা-মুঠ