পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৯২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

*) Գ 8 রবীন্দ্র-রচনাবলী ষোড়শী একটুখানি হাসিল । তার মর্মার্থ এই, এমন-সকল বৃথা উদবেগ সংসারী বিষয়ী লোকেরই যোগ্য বটে । 9ܘܢ বরদা চলিয়া যাওয়ার পরে বারো বৎসর পার হইয়া গেছে ; এখন ষোড়শীর বয়স পঁচিশ । একদিন ষোড়শী তার যোগী শিক্ষককে জিজ্ঞাসা করিল, “বাবা, আমার স্বামী জীবিত আছেন কি না, তা আমি কেমন করে জানিব ।” যোগী প্ৰায় দশ মিনিট কাল স্তব্ধ হইয়া চোখ বুজিয়া রহিলেন ; তার পরে চোখ খুলিয়া বলিলেন, “জীবিত আছেন ।” “কেমন ক’রে জানলেন ।” “সে কথা এখনো তুমি বুঝবে না । কিন্তু, এটা নিশ্চয় জেনো, স্ত্রীলোক হয়েও সাধনার পথে তুমি যে এতদূর অগ্রসর হয়েছ। সে কেবল তোমার স্বামীর অসামান্য তপোবলে । তিনি দূরে থেকেও তোমাকে সহধর্মিণী ক’রে নিয়েছেন ।” ষোড়শীর শরীর মন পুলকিত হইয়া উঠিল । নিজের সম্বন্ধে তার মনে হইল, ঠিক যেন শিব তপস্যা করিতেছেন আর পার্বতী পদ্মবীজের মালা জপিতে জপিতে তার জন্য অপেক্ষা করিয়া আছেন । ষোড়শী আবার জিজ্ঞাসা করিল, “তিনি কোথায় আছেন তা কি জানতে পারি ।” যোগী ঈষৎ হাস্য করিলেন ; তার পরে বলিলেন, “একখানা আয়না নিয়ে এসো ।” ষোড়শী আয়না আনিয়া যোগীর নির্দেশমত তাহার দিকে তাকাইয়া রহিল । আধা ঘণ্টা গেলে যোগী জিজ্ঞাসা করিলেন, “কিছু দেখতে পােচ্ছ ?” ষোড়শী দ্বিধার স্বরে কহিল, “ইহা যেন কিছু দেখা যাচ্ছে, কিন্তু সেটা যে কী তা স্পষ্ট বুঝতে পারছি Gr !” “সাদা কিছু দেখছ কি ৷” “সাদাই তো বটে ।” “যেন পাহাড়ের উপর বরফের মতো ?” “নিশ্চয়ই বরফ ! কখনো পাহাড় তো দেখি নি, তাই এতক্ষণ ঝাপসা ঠেকছিল ।” এইরূপ আশ্চর্য উপায়ে ক্ৰমে ক্ৰমে দেখা গেল, বরদা হিমালয়ের অতি দুৰ্গম জায়গায় লংচু পাহাড়ে বরফের উপর অনাবৃত দেহে বসিয়া আছেন । সেখান হইতে তপস্যার তেজ ষোড়শীকে আসিয়া স্পর্শ করিতেছে, এই এক আশ্চর্য কাণ্ড । সেদিন ঘরের মধ্যে একলা বসিয়া ষোড়শীর সমস্ত শরীর র্কাপিয়া কঁপিয়া উঠিতে লাগিল । তার স্বামীর তপস্যা যে তাকে দিনরাত ঘেরিয়া আছে, স্বামী কাছে থাকিলে মাঝে মাঝে যে বিচ্ছেদ ঘটিতে পারিত সে বিচ্ছেদও যে তার নাই, এই আনন্দে তার মন ভরিয়া উঠিল । তার মনে হইল, সাধনা আরো অনেক বেশি কঠোর হওয়া চাই । এতদিন এবং পৌষ মাসটাতে যে কম্বল সে গায়ে দিতেছিল এখনি সেটা ফেলিয়া দিতেই শীতে তার গায়ে কাটা দিয়া উঠিল । ষোড়শীর মনে হইল, সেই লাংচু পাহাড়ের হাওয়া তার গায়ে আসিয়া লাগিতেছে। হাত জোড় করিয়া চোখ বুজিয়া সে বসিয়া রহিল, চোখের কোণ দিয়া অজস্র জল পড়িতে লাগিল । সেইদিনই মধ্যাহ্নে আহারের পর মাখন ষোড়শীকে তার ঘরে ডাকিয়া আনিয়া বড়োই সংকোচের সঙ্গে বলিলেন, “মা, এতদিন তোমার কাছে বলি নি, ভেবেছিলুম, দরকার হবে না, কিন্তু আর চলছে না। আমার সম্পত্তির চেয়ে আমার দেনা অনেক বেড়েছে, কোনদিন আমার বিষয় ক্রোক করে বলা যায় না ।” ষোড়শীর মুখ আনন্দে দীপ্ত হইয়া উঠিল । তার মনে সন্দেহ রহিল না যে, এ-সমস্তই তার স্বামীর কাজ। তার স্বামী তাকে পূর্ণভাবে আপন সহধর্মিণী করিতেছেন- বিষয়ের যেটুকু ব্যবধান মাঝে ছিল