পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৯৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

邻雷g夜 woዓ ዓ করবার জন্যে নয়, পরের উপকার করারার জন্যেও নয় ; ওটা হচ্ছে কথা কয়ে কয়ে চিন্তা করা, জ্ঞান হজম করবার একটা ব্যায়ামপ্রণালী। আমি যদি লেখক হতুম, কিংবা অধ্যাপক হাতুম, তা হলে বকুনি আমার পক্ষে বাহুল্য হত । যাদের বাধা খাটুনি আছে খাওয়া হজম করবার জন্যে তাদের উপায় খুঁজতে হয় না- যারা ঘরে বসে খায় তাদের অন্তত ছাতের উপর হন।হন করে পায়চারি করা দরকার । আমার সেই দশা । তাই যখন আমার দ্বৈতদলটি জমে নি- তখন আমার একমাত্র দ্বৈত ছিলেন। আমার স্ত্রী । তিনি আমার এই মানসিক পরিপাকের সশব্দ প্রক্রিয়া দীর্ঘকাল নিঃশব্দে বহন করেছেন । যদিচ তিনি পরতেন মিলের শাড়ি এবং তার গয়নার সোনা খাটি এবং নিরেট ছিল না, কিন্তু স্বামীর কাছ থেকে যে আলাপ শুনতেন- সৌজাত্যবিদ্যাই (Eugenics) বল, মেন্ডেল-তত্ত্বই বল, আর গাণিতিক যুক্তিশাস্ত্ৰই বল, তার মধ্যে সন্তা কিংবা ভেজাল-দেওয়া কিছুই ছিল না। আমার দলবৃদ্ধির পর হতে এই আলাপ থেকে তিনি বঞ্চিত হয়েছিলেন, কিন্তু সেজন্যে তার কোনো নালিশ কোনোদিন শুনি নি । আমার স্ত্রীর নাম অনিলা । ঐ শব্দটার মানে কী তা আমি জানি নে, আমার শ্বশুরও যে জানতেন তা নয়। শব্দটা শুনতে মিষ্ট এবং হঠাৎ মনে হয়, ওর একটা-কোনো মানে আছে। অভিধানে যাই বলুক, নামটার আসল মানে— আমার স্ত্রী তার বাপের আদরের মেয়ে । আমার শাশুড়ি যখন আড়াই বছরের একটি ছেলে রেখে মারা যান। তখন সেই ছোটো ছেলেকে যত্ন করবার মনোরম উপায়স্বরাপে আমার শ্বশুর আর একটি বিবাহ করেন। তার উদ্দেশ্য যে কিরকম সফল হয়েছিল তা এই বললেই বোঝা যাবে যে, তার মৃত্যুর দুদিন আগে তিনি আনিলার হাত ধরে বললেন, “মা, আমি তো যাচ্ছি, এখন সরোজের কথা ভাববার জন্যে তুমি ছাড়া আর কেউ রইল না ।” তার স্ত্রী ও দ্বিতীয়পক্ষের ছেলেদের জন্যে কী ব্যবস্থা করলেন তা আমি ঠিক জানি নে । কিন্তু, অনিলার হাতে গোপনে তিনি তার জমানো টাকা প্ৰায় সাড়ে সাত হাজার দিয়ে গেলেন । বললেন, “এ টাকা সুদে খাটাবার দরকার নেই- নগদ খরচ করে এর থেকে তুমি সরোজের লেখাপড়ার ব্যবস্থা করে দিয়ো, ।” আমি এই ঘটনায় কিছু আশ্চর্য হয়েছিলুম। আমার শ্বশুর কেবল বুদ্ধিমান ছিলেন তা নয়, তিনি ছিলেন যাকে বলে বিজ্ঞ । অর্থাৎ, ঝোকের মাথায় কিছুই করতেন না, হিসেব করে চলতেন । তাই তার ছেলেকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করে তোলার ভার যদি কারও উপর তার দেওয়া উচিত ছিল সেটা আমার উপর, এ বিষয়ে আমার সন্দেহ ছিল না । কিন্তু তার মেয়ে তার জামাইয়ের চেয়ে যোগ্য এমন ধারণা যে তার কী করে হল তা তো বলতে পারি নে। অথচ টাকাকড়ি সম্বন্ধে তিনি যদি আমাকে খুব খাটি বলে না জানতেন তা হলে আমার স্ত্রীর হাতে এত টাকা নগদ দিতে পারতেন না। আসল, তিনি ছিলেন ভিক্টোরীয় যুগের ফিলিসটাইন, আমাকে শেষ পর্যন্ত চিনতে পারেন নি । মনে মনে রাগ করে আমি প্রথমটা ভেবেছিলুম, এ সম্বন্ধে কোনো কথাই কব না । কথা কইও নি । বিশ্বাস ছিল, কথা অনিলাকেই প্ৰথম কইতে হবে, এ সম্বন্ধে আমার শরণাপন্ন না হয়ে তার উপায় নেই। কিন্তু, অনিলা যখন আমার কাছে কোনো পরামর্শ নিতে এল না। তখন মনে করলুম, ও বুঝি সাহস করছে না । শেষে একদিন কথায় কথায় জিজ্ঞাসা করলুম, “সরোজের পড়াশুনোর কী করছ।” আনিলা বললে, “মাস্টার রেখেছি, ইস্কুলেও যাচ্ছে।” আমি আভাস দিলুম, সরোজকে শেখাবার ভার আমি নিজেই নিতে রাজি আছি । আজকাল বিদ্যাশিক্ষার যে-সকল নতুন প্ৰণালী বেরিয়েছে তার কতক কতক ওকে বোঝাবার চেষ্টা করলুম। অনিল ই’ও বললে না, নাও বললে না। এতদিন পরে আমার প্রথম সন্দেহ হল, অনিলা আমাকে শ্রদ্ধা করে না । আমি কলেজে পাস করি নি, সেইজন্য সম্ভবত ও মনে করে, পড়াশুনো সম্বন্ধে পরামর্শ দেবার ক্ষমতা এবং অধিকার আমার নেই। এতদিন ওকে সীেজাত্য, অভিব্যক্তিবাদ এবং রেডিয়ো-চাঞ্চল্য সম্বন্ধে যা কিছু বলেছি নিশ্চয়ই আনিলা তার মূল্য কিছুই বোঝে নি। ও হয়তো মনে করেছে, সেকেন্ড ক্লাসের ছেলেও এর চেয়ে বেশি জানে । কেননা, মাস্টারের হাতের কান-মালার প্যাচে প্যাচে বিদ্যেগুলো আঁটি হয়ে তাদের মনের মধ্যে বসে গেছে । রাগ করে। মনে মনে বললুম, মেয়েদের কাছে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করবার আশা সে যেন ছাড়ে বিদ্যাবুদ্ধিই যার প্রধান সম্পদ ।