পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৯৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\OrO V রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী অন্তঃকরণমূলক, এই জেনে আমি নিশ্চিন্ত ছিলুম, এমন সময় একদিন লক্ষ্য করে দেখলুম, সে আমার অযোধ্যাকে অতিক্রম করে টেনিসের পলাতক গোলাটা কুড়িয়ে নিয়ে পাশের বাড়ির দিকে ছুটছে। বুঝলুম, এই উপলক্ষে প্রতিবেশীর সঙ্গে আলাপ করতে চায়। সন্দেহ হল, ওর মনের ভাবটা ঠিক ব্ৰহ্মবাদিনী মৈত্রেয়ীর মতো নয়- শুধু অমৃতে ওর পেট ভরবে না । আমি পয়লা-নম্বরের বাবুগিরিকে খুব তীক্ষ বিদুপ করবার চেষ্টা করতুম। বলতুম, সাজসজ্জা দিয়ে মনের শূন্যতা ঢাকা দেওয়ার চেষ্টা ঠিক যেন রঙিন মেঘ দিয়ে আকাশ মুড়ি দেবার দুরাশা। একটু হাওয়াতেই মেঘ যায় সরে, আকাশের ফাকা বেরিয়ে পড়ে । কানাইলাল একদিন প্ৰতিবাদ করে বললে, মানুষটা একেবারে নিছক-ফাপা নয়, বি-এ পাস করেছে। কানাইলাল স্বয়ং বি-এ পাস-করা, এজন্য ঐ ডিগ্ৰীটা সম্বন্ধে কিছু বলতে পারলুম না । পয়লা-নম্বরের প্রধান গুণগুলি সশব্দ । তিনি তিনটে যন্ত্র বাজাতে পারেন, কর্নেট, এসরাজ এবং চেলো । যখন-তখন তার পরিচয় পাই । সংগীতের সুর সম্বন্ধে আমি নিজেকে সুরাচার্য বলে অভিমান করি নে। কিন্তু, আমার মতে গানটা উচ্চ অঙ্গের বিদ্যা নয়। ভাষার অভাবে মানুষ যখন বোবা ছিল তখনই গানের উৎপত্তি- তখন মানুষ চিন্তা করতে পারত না বলে চীৎকার করত । আজও যে-সব মানুষ আদিম অবস্থায় আছে তারা শুধু শুধু শব্দ করতে ভালোবাসে। কিন্তু দেখতে পেলুম, আমার দ্বৈতদলের মধ্যে অন্তত চারজন ছেলে আছে, পয়লা-নম্বরে চেলো বেজে উঠলেই যারা গাণিতিক ন্যায়শাস্ত্রের নব্যতম অধ্যায়েও মন দিতে পারে না । আমার দলের মধ্যে অনেক ছেলে যখন পয়লা-নম্বরের দিকে হেলছে এমন সময়ে অনিলা একদিন আমাকে বললে, “পাশের বাড়িতে একটা উৎপাত জুটেছে, এখন আমরা এখান থেকে অন্য কোনো বাসায় গেলেই তো ভালো হয় ।” বড়ো খুশি হলুম। আমার দলের লোকদের বললুম, “দেখেছ মেয়েদের কেমন একটা সহজ বোধ আছে ? তাই যে-সব জিনিস প্রমাণযোগে বোঝা যায় তা ওরা বুঝতেই পারে না, কিন্তু যে-সব জিনিসের কোনো প্রমাণ নেই তা বুঝতে ওদের একটুও দেরি হয় না ।” 曝 পতিদেবতা-পূজার পুণ্যফল ইত্যাদি ইত্যাদি ।” আমি বললুম, “না হে, এই দেখো-না, আমরা এই পয়লা-নম্বরের জাকজমক দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেছি, কিন্তু আনিলা ওর সাজসজায় ভোলে নি ।” অনিলা দু-তিনবার বাড়ি-বদলের কথা বললে । আমার ইচ্ছাও ছিল, কিন্তু কলকাতার গলিতে গলিতে বাসা খুঁজে বেড়াবার মতো অধ্যবসায় আমার ছিল না । অবশেষে একদিন বিকেলবেলায় দেখা গেল, কানাইলাল এবং সতীশ পয়লা-নম্বরে টেনিস খেলছে। তার পরে জনশ্রুতি শোনা গেল, যতি আর হরেন। পয়লা-নম্বরে সংগীতের মজলিসে একজন বক্স-হার্মেনিয়ম বাজায় এবং একজন বায়া-তবলায় সংগত করে, আর অরুণ নাকি সেখানে কমিক গান করে খুব প্রতিপত্তি লাভ করেছে। এদের আমি পাঁচ-ছ বছর ধরে জানি। কিন্তু এদের যে এ-সব গুণ ছিল তা আমি সন্দেহও করি নি । বিশেষত আমি জানতুম, অরুণের প্রধান শখের বিষয় হচ্ছে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব । সে যে কমিক গানে ওস্তাদ তা কী করে বুঝব। সত্য কথা বলি, আমি এই পয়লা-নম্বরকে মুখে যতই অবজ্ঞা করি মনে মনে ঈর্ষা করেছিলুম। আমি চিন্তা করতে পারি, বিচার করতে পারি, সকল জিনিসের সার গ্রহণ করতে পারি, বড়ো বড়ো সমস্যার সমাধান করতে পারি- মানসিক সম্পদে সিতাংশুমেীলীকে আমার সমকক্ষ বলে কল্পনা করা অসম্ভব । কিন্তু তবু ঐ মানুষটিকে আমি ঈর্ষা করেছি। কেন সে কথা যদি খুলে বলি তো লোকে হাসবে। সকালবেলায় সিতাংশু একটা দুরন্ত ঘোড়ায় চড়ে বেড়াতে বেরোত--- কী আশ্চর্য নৈপুণ্যের সঙ্গে রাশ বাগিয়ে এই জন্তুটাকে সে সংযত করত । এই দৃশ্যটি রোজই আমি দেখতুম, আর ভাবতুম, ‘আহা, আমি যদি এইরকম অনায়াসে ঘোড়া হাকিয়ে যেতে পারতুম !”। পটুত্ব রলে যে জিনিসটি আমার