পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৯৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ና፲፭q}ጂ \Otry একেবারেই নেই সেইটের ‘পরে আমার ভারি একটা গোপন লোভ ছিল । আমি গানের সুর ভালো বুঝি নে কিন্তু জানলা থেকে কতদিন গোপনে দেখেছি। সিতাংশু এসরাজ বাজাচ্ছে। ঐ যন্ত্রটার পরে তার একটি বাধাহীন সৌন্দর্যময় প্রভাব আমার কাছে আশ্চর্য মনোহর বোধ হত । আমার মনে হত, যন্ত্রটা যেন প্ৰেয়সী-নারীর মতো। ওকে ভালোবাসে- সে আপনার সমস্ত সুর ওকে ইচ্ছা করে বিকিয়ে দিয়েছে। জিনিস-পত্র বাড়ি-ঘর জন্তু-মানুষ সকলের পরেই সিতাংশুর এই সহজ প্রভাব ভারি একটি শ্ৰী বিস্তার করত । এই জিনিসটি অনির্বচনীয়, আমি একে নিতান্ত দুর্লভ না মনে করে থাকতে পারতুম না। আমি মনে করতুম, পৃথিবীতে কোনো কিছু প্রার্থনা করা এ লোকটির পক্ষে অনাবশ্যক, সবই আপনি এর কাছে এসে পড়বে, এ ইচ্ছা করে যেখানে গিয়ে বসবে সেইখানেই এর আসন পাতা । তাই যখন একে একে আমার দ্বৈতগুলির অনেকেই পয়লা-নম্বরে টেনিস খেলতে , কন্সট বাজাতে লাগল, তখন স্থানত্যাগের দ্বারা এই লুন্ধাদের উদ্ধার করা ছাড়া আর কোনো উপায় খুঁজে পেলুম না । দালাল এসে খবর দিলে, মনের মতো অন্য বাসা বরানগর-কাশীপুরের কাছাকাছি এক জায়গায় পাওয়া, যাবে। আমি তাতে রাজি । সকাল তখন সাড়ে নটা । স্ত্রীকে প্ৰস্তুত হতে বলতে গেলুম । তাকে ভাড়ারঘরেও পেলুম না, রান্নাঘরেও না । দেখি, শোবার ঘরে জানলার গরাদের উপর মাথা রেখে চুপ করে বসে আছেন । আমাকে দেখেই উঠে পড়লেন । আমি বললুম, “পর্তই নতুন বাসায় যাওয়া যাবে ।” তিনি বললেন, “আর দিন পনেরো সবুর করো ।” জিজ্ঞাসা করলুম, “কেন।” আনিলা বললেন, “সরোজের পরীক্ষার ফল শীঘ্ৰ বেরোবে- তার জন্য মনটা উদবিগ্ন আছে, এ কয়দিন আর নড়াচড়া করতে ভালো লাগছে না ।” অন্যান্য অসংখ্য বিষয়ের মধ্যে এই একটি বিষয় আছে যা নিয়ে আমার স্ত্রীর সঙ্গে আমি কখনো আলোচনা করি নে। সুতরাং আপাতত কিছুদিন বাড়িবদল মুলতবি রইল । ইতিমধ্যে খবর পেলুম, সিতাংশু শীঘ্রই দক্ষিণভারতে বেড়াতে বেরোবে, সুতরাং দুই-নম্বরের উপর থেকে মস্ত ছায়াটা সরে যাবে । অদৃষ্ট নাট্যের পঞ্চমাঙ্কের শেষ দিকটা হঠাৎ দৃষ্ট হয়ে ওঠে । কাল আমার স্ত্রী তার বাপের বাড়ি গিয়েছিলেন ; আজ ফিরে এসে র্তার ঘরে দরজা বন্ধ করলেন। তিনি জানেন, আজ রাত্রে আমাদের দ্বৈতদলের পূর্ণিমার ভোজ । তাই নিয়ে তার সঙ্গে পরামর্শ করবার অভিপ্ৰায়ে দরজায় ঘা দিলুম। প্রথমে সাড়া পাওয়া গেল না । ডাক দিলুম, “অনু!” খানিক বাদে অনিল এসে দরজা, খুলে দিলে । আমি জিজ্ঞাসা করলুম, “আজ রাত্রে রান্নার জোগাড় সব ঠিক আছে তো ?” সে কোনো জবাব না দিয়ে মাথা হেলিয়ে জানালে যে, আছে । আমি বললুম, “তোমার হাতের তৈরি মাছের কচুরি আর বিলাতি আমড়ার চাটনি ওদের খুব ভালো লাগে, সেটা ভুলো না ।” এই বলে বাইরে এসেই দেখি কানাইলাল বসে আছে । আমি বললুম, “কানাই, আজ তোমরা একটু সকাল-সকাল এসো।” কানাই আশ্চর্য হয়ে বললে, “সে কী কথা । আজ আমাদের সভা হবে না কি ৷” আমি বললুম, “হবে বৈকি। সমস্ত তৈরি আছে- ম্যাক্সিম গর্কির নতুন গল্পের বই, বেৰ্গসর উপর রাসেলের সমালোচনা, মাছের কচুরি, এমন-কি, আমড়ার চাটনি পর্যন্ত ।” কানাই অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে চেয়ে রইল। খানিক বাদে বললে, “অদ্বৈতবাবু, আমি বলি, আজ থাকা ।” অবশেষে প্রশ্ন করে জানতে পারলুম, আমার শ্যালক সরোজ কাল বিকেলবেলায়, আত্মহত্যা করে মরেছে। পরীক্ষায় সে পাস হতে পারে নি, তাই নিয়ে বিমাতার কাছ থেকে খুব গঞ্জনা পেয়েছিলসইতে না পেরে গলায় চাদর বেঁধে মরেছে।