পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪০৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

○brやり রবীন্দ্র-রচনাবলী খোপা মোড়া, আর গায়ে কলকাতার দোকানের এক সাটিনের জ্যাকেট- সেটা নীল এবং লাল এবং লেস এবং ফিতের একটা প্রত্যক্ষ প্ৰলাপ । যতটা মনে পড়ছে- রঙ শামলা ; ভুরু-জোড়া খুব ঘন ; এবং চোখদুটাে পোষা প্রাণীর মতো, বিনা সংকোচে তাকিয়ে আছে। মুখের বাকি অংশ কিছুই মনে পড়ে না— বােধ হয় বিধাতার কারখানায় তার গড়ন তখনো সারা হয় নি, কেবল একমেটে করে রাখা হয়েছে । আর যাই হােক, তাকে দেখতে নেহাত ভালোমানুষের মতো । আমার বুকের ভিতরটা ফুলে উঠল। মনে মনে বুঝলুম, ঐ রাংতা-জড়ানো বেণীওয়ালা জ্যাকেট-মোড়া সামগ্ৰীটি ষোলো-আনা আমার- আমি ওর প্রভু, আমি ওর দেবতা । অন্য সমস্ত দুর্লভ সামগ্ৰীর জন্যেই সাধনা করতে হয়, কেবল এই একটি জিনিসের জন্য নয় ; আমি কড়ে আঙুল নড়ালেই হয় ; বিধাতা এই বর দেবার জন্যে আমাকে সেধে বেড়াচ্ছেন । মা’কে যে আমি বরাবর দেখে আসছি, স্ত্রী বলতে কী বোঝায় তা আমার ঐ সূত্রে জানা ছিল। দেখেছি, বাবা অন্য সমস্ত ব্ৰতের উপর চটা ছিলেন। কিন্তু সাবিত্রীব্রতের বেলায় তিনি মুখে যাই বলুন, মনে মনে বেশ একটু আনন্দ বোধ করতেন । মা তাকে ভালোবাসতেন তা জানি, কিন্তু কিসে বাবা রাগ করবেন, কিসে তার বিরক্তি হবে, এইটোকে মা যে একান্ত মনে ভয় করতেন, এরই রাসটুকু বাবা তার সমস্ত পৌরুষ দিয়ে সব চেয়ে উপভোগ করতেন । পূজাতে দেবতাদের বোধ হয়। বড়ো-একটা-কিছু আসে যায় না, কেননা সেটা তাদের বৈধ বরাদ । কিন্তু মানুষের নাকি ওটা অবৈধ পাওনা, এইজন্যে ঐটের লোভে তাদের অসামাল করে। সেই বালিকার রূপগুণের টান সেদিন আমার উপরে পৌঁছয় নি, কিন্তু আমি যে পূজনীয় সে কথাটা সেই চোদ্দ বছর বয়সে আমার পুরুষের রক্তে গাজিয়ে উঠল। সেদিন খুব গৌরবের সঙ্গেই আমগুলো খেলুম, এমন-কি, সগর্বে তিনটে আম পাতে বাকি রাখলুম, যা আমার জীবনে কখনো ঘটে নি ; এবং তার জন্যে সমস্ত অপরাহুকালটা অনুশোচনায় গেল । সেদিন কাশীশ্বরী খবর পায় নি আমার সঙ্গে তার সম্বন্ধটা কোন শ্রেণীর— কিন্তু বাড়ি গিয়েই বোধ হয় জানতে পেরেছিল । তার পরে যখনই তার সঙ্গে দেখা হত সে শশব্যস্ত হয়ে লুকোবার জায়গা পেত না । আমাকে দেখে তার এই ত্ৰস্ততা আমার খুব ভালো লাগত। আমার আবির্ভাব বিশ্বের কোনো-একটা জায়গায় কোনো-একটা আকারে খুব একটা প্রবল প্রভাব সঞ্চার করে, এই জৈব-রাসায়নিক তথ্যটা আমার কাছে বড়ো মনোরম ছিল । আমাকে দেখেও যে কেউ ভয় করে বা লজ্জা করে, বা কোনো একটা-কিছু করে, সেটা বড়ো অপূর্ব । কাশীশ্বরী তার পালানোর দ্বারাই আমাকে জানিয়ে যেত, জগতের মধ্যে সে বিশেষভাবে সম্পূর্ণভাবে এবং নিগৃঢ়ভাবে আমারই । এতকালের অকিঞ্চিৎকরত থেকে হঠাৎ এক মুহুর্তে এমন একান্ত গৌরবের পদ লাভ ক’রে কিছুদিন আমার মাথার মধ্যে রক্ত বঁাঝা করতে লাগিল । বাবা যেরকম মাকে কর্তব্যের বা রন্ধনের বা ব্যবস্থার ক্রটি নিয়ে সর্বদা ব্যাকুল করে তুলেছেন, আমিও মনে মনে তারই ছবির উপরে দাগা বুলোতে লাগলুম । বাবার অনভিপ্ৰেত কোনো-একটা লক্ষ্য সাধন করবার সময় মা যেরকম সাবধানে নানাপ্রকার মনোহর কৌশলে কাজ উদ্ধার করতেন, আমি কল্পনায় কাশীশ্বরীকেও সেই পথে প্ৰবৃত্ত হতে দেখলুম। মাঝে মাঝে মনে মনে তাকে অকাতরে এবং অকস্মাৎ মোটা অঙ্কের ব্যাঙ্কনোট থেকে আরম্ভ ক’রে হীরের গয়না পর্যন্ত দান করতে আরম্ভ করলুম। এক-একদিন ভাত খেতে বসে তার খাওয়াই হল না এবং জানলার ধারে বসে আঁচলের খুঁট দিয়ে সে চোখের জল মুচছে, এই করুণ দৃশ্যও আমি মনশ্চক্ষে দেখতে পেলুম এবং এটা যে আমার কাছে অত্যন্ত শোচনীয় বোধ হল তা বলতে পারি নে । ছোটো ছেলেদের আত্মনির্ভরতার সম্বন্ধে বাবা অত্যন্ত বেশি সতর্ক ছিলেন । নিজের ঘর ঠিক করা, নিজের কাপড়াচোপড় রাখা সমস্তই আমাকে নিজের হাতে করতে হত । কিন্তু আমার মনের মধ্যে গাৰ্হস্থ্যের যে-চিত্রগুলি স্পষ্ট রেখায় জেগে উঠল, তার মধ্যে একটি নীচে লিখে রাখছি। বলা বাহুল্য, আমার পৈতৃক ইতিহাসে ঠিক এইরকম ঘটনাই পূর্বে একদিন ঘটেছিল ; এই কল্পনার মধ্যে আমার ওরিজিনালিটি কিছুই নেই। চিত্রটি এই-- রবিবারে মধ্যাহ্নভোজনের পর আমি খাটের উপর বালিশে ঠেসান দিয়ে পা ছডিয়ে আধ-শোওয়া অবস্থায় খবরের কাগজ পড়ছি । হাতে গুড়গুড়ির নল। ঈষৎ