পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪১০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

WSO SR রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী মুখ থুবড়ে পড়ে মরতে হবে !! আর সেরি করলে তো চলবে না। সম্প্রতি চল্লিশ পেরিয়েছিযৌবনের শেষ থলিটি ঝেড়ে নেবার জন্যে পঞ্চাশ রান্তার ধারে বসে আছে, তার লাঠির ডগাটা এইখান থেকে দেখা যাচ্ছে। এখন পকেটের কথাটা বন্ধ রেখে জীবনের কথা একটুখানি ভেবে দেখা যাক । কিন্তু, জীবনের যে-অংশে মুলতুবি পড়েছে সে-অংশে আর তো ফিরে যাওয়া চলবে না। তবু তার ছিন্নতায় তালি লাগাবার সময় এখনো সম্পূর্ণ যায় নি । এখান থেকে কাজের গতিকে পশ্চিমের এক শহরে যেতে হল । সেখানে বিশ্বপতিবাবু ধনী বাঙালি মহাজন । তাকে নিয়ে আমার কাজের কথা ছিল । লোকটি খুব উইশিয়ার, সুতরাং তার সঙ্গে কোনো কথা পাকা করতে বিস্তর সময় লাগে । একদিন বিরক্ত হয়ে যখন ভাবছি। ‘একে নিয়ে আমার কাজের সুবিধা হবে না, এমন-কি, চাকরকে আমার জিনিসপত্র প্যাক করতে বলে দিয়েছি, হেনকালে বিশ্বপতিবাবু সন্ধ্যার সময় এসে আমাকে বললেন, “আপনার সঙ্গে নিশ্চয়ই অনেকরকম লোকের আলাপ আছে, আপনি একটু মনোযোগ করলে একটি বিধবা বেঁচে যায়।” ঘটনাটি এই।-- নন্দকৃষ্ণবাবু বেরেলিতে প্ৰথমে আসেন একটি বাঙালি-ইংরাজি স্কুলের হেডমাস্টার হয়ে । কাজ করেছিলেন খুব ভালো। সকলেই আশ্চর্য হয়েছিল- এমন সুযোগ্য সুশিক্ষিত লোক দেশ ছেড়ে, এত দূরে সামান্য বেতনে চাকরি করতে এলেন কী কারণে। কেবল যে পরীক্ষা পাস করাতে তার খ্যাতি ছিল তা নয়, সকল ভালো কাজেই তিনি হাত দিয়েছিলেন । এমন সময় কেমন করে বেরিয়ে পড়ল, তার স্ত্রীর রূপ ছিল বটে কিন্তু কুল ছিল না ; সামান্য কোন জাতের মেয়ে, এমন-কি, তার ছোওয়া লাগলে পানীয় জলের পানীয়তা এবং অন্যান্য নিগৃঢ় সাত্ত্বিক গুণ নষ্ট হয়ে যায়। তাকে যখন সবাই চেপে ধরলে তিনি বললেন, হা, জাতে ছোটাে বটে, কিন্তু তবু সে তার স্ত্রী । তখন প্রশ্ন উঠল, এমন বিবাহ বৈধ হয় কী করে । যিনি প্রশ্ন করেছিলেন নন্দকৃষ্ণবাবু তাকে বললেন, “আপনি তো শালগ্রাম সাক্ষী করে পরে পরে দুটি স্ত্রী বিবাহ করেছেন, এবং দ্বিবচনেও সন্তুষ্ট নেই তার বহু প্রমাণ দিয়েছেন । শালগ্রামের কথা বলতে পারি। নে কিন্তু অন্তর্যামী জানেন, আমার বিবাহ আপনার বিবাহের চেয়ে বৈধ, প্রতিদিন প্রতি মুহুর্তে বৈধ- এর চেয়ে বেশি কথা আমি আপনাদের সঙ্গে আলোচনা করতে চাই (କମ୍ୟ ।” যাকে নন্দকৃষ্ণ এই কথাগুলি বললেন তিনি খুশি হন নি। তার উপরে লোকের অনিষ্ট করবার ক্ষমতাও তার অসামান্য ছিল । সুতরাং সেই উপদ্রবে নন্দকৃষ্ণ বেরিলি ত্যাগ করে এই বর্তমান শহরে এসে ওকালতি শুরু করলেন । লোকটা অত্যন্ত খুঁতখুঁতে ছিলেন- উপবাসী থাকলেও অন্যায় মকদ্দমা তিনি কিছুতেই নিতেন না। প্রথমটা তাতে তার যত অসুবিধা হােক, শেষকালে উন্নতি হতে লাগল। কেননা, হাকিমরা তাকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতেন। একখানি বাড়ি করে একটু জমিয়ে বসেছেন এমন সময় দেশে মন্বন্তর এল । দেশ উজাড় হয়ে যায় । যাদের উপর সাহায্য বিতরণের ভার ছিল তাদের মধ্যে কেউ কেউ চুরি করছিল বলে তিনি ম্যাজিষ্ট্রেটকে জানাতেই ম্যাজিষ্ট্রেট বললেন, “সাধুলোক পাই কোথায় ?” তিনি বললেন, “আমাকে যদি বিশ্বাস করেন। আমি এ কাজের কতক ভার নিতে পারি।” তিনি ভার পেলেন এবং এই ভার বহন করতে করতেই একদিন মধ্যাহ্নে মাঠের মধ্যে এক গাছতলায় মারা যান। ডাক্তার বললে, তার হৃৎপিণ্ডের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যু হয়েছে। গল্পের এতটা পর্যন্ত আমার পূর্বেই জানা ছিল। কেমন একটা উচ্চ ভাবের মেজাজে ঐরই কথা তুলে আমাদের ক্লাবে আমি বলেছিলুম, “এই নন্দকৃষ্ণের মতো লোক যারা সংসারে ফেল করে শুকিয়ে মরে গেছে- না রেখেছে নাম, না রেখেছে। টাকা- তারাই ভগবানের সহযোগী হয়ে সংসারটাকে উপরের দিকে-” এইটুকু মাত্র বলতেই ভরা পালের নীেকা হঠাৎ চড়ায় ঠেকে যাওয়ার মতো, আমার কথা মাঝখানে