পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪১৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

WV) রবীন্দ্র-রচনাবলী পিসিমা হাসলেন, আর চোখের জল মুছলেন । তার মনের মধ্যে কিছু দ্বিধাও হল ; বললেন, “অনেকদিন থেকে ইচ্ছে ছিল, মেয়েটার কোনো-একটা গতি করে শেষ বয়সে তীৰ্থ করে বেড়াবি“কিন্তু বাবা, আজ যে তার উলটাে পথে টেনে নিয়ে চললি ।” আমি বললুম, “পিসিমা, আমিই তোমার সচল তীৰ্থ । যে-কোনো ত্যাগের ক্ষেত্রেই তুমি আত্মদান কর-না কেন, সেইখানেই তোমার দেবতা। আপনি এসে তা গ্ৰহণ করবেন । তোমার যে পুণ্য আত্মা !” সব চেয়ে একটা যুক্তি তার মনে প্রবল হল । তার আশঙ্কা ছিল, স্বভাবতই আমার প্রবৃত্তির ঝোকটা আন্ডামান-মুখো, অতএব কেউ আমাকে সামলাবার না থাকলে অবশেষে একদিন পুলিসের বাহুবন্ধনে বন্ধ হবই। তার মতলব ছিল, যে কোমল বাহুবন্ধন তার চেয়ে অনেক বেশি কঠিন ও স্থায়ী, আমার জন্য তারই ব্যবস্থা করে দিয়ে তবে তিনি তীর্থভ্ৰমণে বার হবেন । আমার বন্ধন নইলে তার মুক্তি নেই। আমার চরিত্র সম্বন্ধে এইখানে ভুল হিসেব করেছিলেন । কুষ্ঠিতে আমার বধ-বন্ধনের গ্রহটি অন্তিমে আমাকে শকুনি-গৃধিনীর হাতে সঁপে দিতে নারাজ ছিলেন না, কিন্তু প্ৰজাপতির হাতে নৈব নৈব চ। কন্যাকর্তারা ক্ৰটি করেন নি, তাদের সংখ্যাও অজস্র । আমার পৈতৃক সম্পত্তির বিপুল সচ্ছলতার কথা সকলেই জানত ; অতএব, ইচ্ছা করলে সম্ভবপর শ্বশুরকে দেউলে করে দিয়ে কন্যার সঙ্গে সঙ্গে বিশ-পঁচিশ হাজার টাকা নহবতে সাহানা বাজিয়ে হাসতে হাসতে আদায় করতে পারতেম । করি নি । আমার ভাবী চরিতলেখক এ কথা যেন স্মরণ রাখেন যে, স্বদেশসেবার সংকল্পের কাছে এককালীন আমার এই বিশ-পচিশ হাজার টাকার ত্যাগ। জমা-খরচের অঙ্কটা অদৃশ্য কালিতে লেখা আছে বলে যেন আমার প্রশংসার হিসাব থেকে বাদ না পড়ে । পিতামহ ভীষ্মের সঙ্গে আমার মহৎ চরিত্রের এইখানে মিল আছে । পিসিমা শেষ পর্যন্ত আশা ছাড়েন নি । এমন সময়ে ভারতের পোলিটিক্যাল আকাশে আমাদের সেই ক্ষত্রিযুগের পরবতী যুগের হাওয়া বইল। পূর্বেই বলেছি, এখনকার পালায় আমরা প্রধান নায়ক নই, তবু ফুটু লাইটের অনেক পিছনে মাঝে মাঝে নিস্তেজভাবে আমাদের আসা-যাওয়া চলছে। এত নিস্তেজ যে, পিসিমা আমার সম্বন্ধে নিশ্চিন্তই ছিলেন । আমার জন্যে কালীঘাটে স্বস্ত্যয়ন করবার ইচ্ছে এককালে তার ছিল, কিন্তু ইদানীং আমার ভাগ্য-আকাশে লাল-পাগড়ির রক্তমেঘ একেবারে অদৃশ্য থাকাতে তার আর খেয়াল রইল না। এইটেই ভুল করলেন । সেদিন পুজোর বাজারে ছিল খন্দরের পিকেটিং। নিতান্ত কেবল দর্শকের মতন গিয়েছিলেমআমার উৎসাহের তাপমাত্রা ৯৮ অঙ্কেরও নীচে ছিল, নাড়িতে বেশি বেগ ছিল না । সেদিন যে আমার কোনো আশঙ্কার কারণ থাকতে পারে সে-খবর আমার কুষ্ঠির নক্ষত্র ছাড়া আর-সবার কাছে ছিল অগোচর। এমন সময় খদ্দর প্রচারকারিণী কোনো বাঙালি মহিলাকে পুলিস-সার্জেন্ট দিলে ধাকা । মুহুর্তের মধ্যেই আমার অহিংস অসহযোগের ভাবখানা প্রবল দুঃসহযোগে পরিণত হল । সুতরাং অনতিবিলম্বে থানায় হল আমার গতি । তার পরে যথানিয়মে হাজাতের লালায়িত কবলের থেকে জেলখানার অন্ধকার জঠরদেশে অবতরণ করা গেল। পিসিমাকে বলে গেলেম, “এইবার কিছুকালের জন্যে তোমার মুক্তি । আপাতত আমার উপযুক্ত অভিভাবকের অভাব রইল না, অতএব এই সুযোগে তুমি তীর্থভ্ৰমণ করে নাওগে । অমিয়া থাকে কলেজের হস্টেলে ; বাড়িতেও দেখবার-শোনবার লোক আছে ; অতএব, এখন তুমি দেবসেবায় ষোলো আনা মন দিলে দেবমানব কারও কোনো আপত্তির কথা থাকবে না ।” জেলখানাকে জেলখানা বলেই গণ্য করে নিয়েছিলেম । সেখানে কোনোরকম দাবিদাওয়া আবদার উৎপাত করি নি । সেখানে সুখ, সম্মান, সৌজন্য, সুহৃৎ ও সুখাদ্যের অভাবে অত্যন্ত বেশি বিস্মিত হই নি। কঠোর নিয়মগুলোকে কঠোরভাবেই মেনে নিয়েছিলেম। কোনোরকম আপত্তি করাটাই লজার বিষয় বলে মনে করতেম। মেয়াদ পুরো হবার কিছু পূর্বেই দুটি পাওয়া গেল। চারি দিকে খুব হাততালি। মনে হল যেন বাংলাদেশের হাওয়ায় বাজতে লাগল, “এনকোর ! একসেলেন্টু !” মনটা খারাপ হল । ভাবলেম, যে