পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪১৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ Vale অমিয়া বলে, “তা হােক-না দাদা, এখনো-আর কিছুক্ষণ-” আমি বলি, “না, না, সে কি হয় । কর্তব্য সব আগে ।” কিন্তু প্ৰায়ই দেখতে পাই, কর্তব্যের অনেক আগেই অনিল এসে উপস্থিত হয় । তাতে অমিয়ার কর্তব্য-উৎসাহের পালে যেন দমকা হাওয়া লাগে, আমাকে বড়ো বেশি-কিছু বলতে হয় না । শুধু অনিল নয়, বিদ্যালয়-বর্জক আরো অনেক উৎসাহী যুবক আমার বাড়ির একতলায় বিকেলে চা! এবং ইনস্পিরেশন গ্ৰহণ করতে একত্র হয়। তারা সকলেই অমিয়াকে যুগলক্ষ্মী বলে সম্ভাষণ করে । , একরকম পদবী আছে, যেমন রায়বাহাদুর, পাট-করা চাদরের মতো, যাকেই দেওয়া যায় নির্ভাবনায় কঁধে বুলিয়ে বেড়াতে পারে । আর-একরকম পদবী আছে, যার ভাগ্যে জোটে সে বেচারা নিজেকে পদবীর সঙ্গে মাপসই করবার জন্যে অহরহ উৎকণ্ঠিত হয়ে থাকে। স্পষ্টই বুঝলেম, অমিয়ার সেই অবস্থা । সর্বদাই অত্যন্ত বেশি উৎসাহ প্ৰদীপ্ত হয়ে না থাকলে তাকে মানায় না । খেতে শুতে তার সময় না-পাওয়াটা বিশেষ সমারোহ করেই ঘটে । এ পাড়ায় ও পাড়ায় খবর পৌঁছয় । কেউ যখন বলে, এমন করলে শরীর টিকবে কী করে, সে একটুখানি হাসে- আশ্চর্য সেই হাসি। ভক্তরা বলে “আপনি একটু বিশ্রাম করুন গে, একরকম করে কাজটা সেরে নেব, সে তাতে ক্ষুদ্র হয়- ক্লান্তি থেকে বাচানোই কি বড়ো কথা । দুঃখগৌরব থেকে বঞ্চিত করা কি কম বিড়ম্বনা । তার ত্যাগ স্বীকারের ফর্দের মধ্যে আমিও পড়ে গেছি। আমি যে তার এতবড়ো জেল-খাটা দাদা- উল্লাসকর কানাই বারীন উপেন্দ্ৰ প্রভৃতির সঙ্গে এক জ্যোতিষ্কমণ্ডলীতে যার স্থান, গীতার দ্বিতীয় অধ্যায় পার হয়ে তার যে-দাদা গীতার শেষ দিকের অধ্যায়ের মুখে অগ্রসর হয়েছে, তাকেও যথোচিত পরিমাণে দেখবার সে সময় পায় না । এত বড়ো স্যাক্রিাফাইস ! যেদিন কোনো কারণে তার দলের লোকের অভাব হয়েছে সেদিন আমিও তার উৎসাহের মীেতাত জোগাবার জন্যে বলেছি, “অমিয়া, ব্যক্তিগত মানুষের সঙ্গে সম্বন্ধ তোর জন্যে নয়, তোর জন্যে বর্তমান যুগ।” আমার কথাটা সে গভীরমুখে নীরবে মেনে নিয়েছে। জেলে যাওয়ার পর থেকে আমার হাসি অন্তঃশীলা বইছে- যারা আমাকে চেনে না তারা বাইরে থেকে আমাকে খুব গভীর বলেই মনে করে । বিছানায় একলা পড়ে পড়ে কড়িকাঠের দিকে চেয়ে চেয়ে ভাবছি, বিমুখা বান্ধবা যান্তি । হঠাৎ মনে পড়ে গেল, সেদিন কোথা থেকে একটা ন্যাঙলা কুকুর আমার বারান্দার কোণে আশ্রয় খুঁজছিল। গায়ের রোওয়া উঠে গেছে, জীৰ্ণ চামড়ার তলায় কঙ্কালের আৰু নেই- আধমরা তার অবস্থা । অত্যন্ত ঘূণার সঙ্গে তাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিলেম । আজ ভাবছিলেম, এতটা বেশি ঝাজের সঙ্গে তাকে তাড়ালেম কেন । বেগানা কুকুর বলে নয়, ওর সর্বাঙ্গে মরণব্দশা দেখা দিয়েছে বলে । প্ৰাণের সংগীতসভায় ওর অস্তিত্বটা বেসুরো, ওর রুগণতা বেয়াদবি । ওর সঙ্গে নিজের তুলনা মনে এল । চারি দিকের চলমান প্রাণের ধারার মধ্যে আমার অস্বাস্থ্য একটা স্থাবর পদার্থ, স্রোতের বাধা। সে দাবি করে, “শিয়রের কাছে চুপ করে বসে থাকো ।” প্ৰাণের দাবি, “দিকে বিদিকে চলে বেড়াও ।” রোগের বাধনে যে নিজে বদ্ধ অরোগীকে সে বন্দী করতে চায়- এটা একটা অপরাধ । অতএব, জীবলোকের উপর সব দাবি একেবারে পরিত্যাগ করব মনে করে গীতা খুলে বসলেম । প্রায় যখন স্থিতধী অবস্থায় এসে পৌঁচেছি, মনটা রোগ-আরোগের দ্বন্দ্ব ছাড়িয়ে গেছে, এমন সময় অনুভব করলেম, কে আমার পা ছুঁয়ে প্ৰণাম করলে। গীতা থেকে চোখ নামিয়ে দেখি, পিসিমার পোষ্যমণ্ডলীভুক্ত একটি মেয়ে। এ পর্যন্ত দূরের থেকেই সাধারণভাবেই তাকে জানি ; বিশেষভাবে তার পরিচয় জানি নে- তার নাম পর্যন্ত আমার অবিদিত। মাথায় ঘোমটা টেনে ধীরে ধীরে সে আমার পায়ে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। তখন মনে পড়ল, মাঝে মাঝে সে আমার দরজার বাইরের কোণে ছায়ার মতো এসে বার বার ফিরে ফিরে গেছে। বোধ করি সাহস করে ঘরে ঢুকতে পারেনি। আমার অজ্ঞাতসারে আমার মাথা-ধরার, গায়ে-ব্যথার ইতিবৃত্তান্ত সে আড়াল থেকে অনেকটা জেনে গিয়েছে। আজ সে লজ্জাভয় দূর করে ঘরের মধ্যে এসে প্ৰণাম করে বসল। আমি যে একদিন একজন মেয়েকে অপমান থেকে বঁাচাবার জন্যে দুঃখ-স্বীকারের অর্ঘ্য নারীকে দিয়েছি, সে হয়তো-বা দেশের সমস্ত মেয়ের হয়ে আমার পায়ের