পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪২১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ 8の○ ব্যাপারটা ঘটেছিল কাল শনিবার দিনে । সেদিন আমাদের পাড়ায় জৈনদের মহলে কী একটা পরব ছিল। আমার স্ত্রী কলিকাকে নিয়ে মোটরে করে বেরিয়েছিলুম- চায়ের নিমন্ত্রণ ছিল বন্ধু নয়নমোহনের বাড়িতে । স্ত্রীর কলিকা নামটি শ্বশুর-দত্ত, আমি ওর জন্য দায়ী নই। নামের উপযুক্ত র্তার স্বভাব নয়, মতামত খুবই পরিস্ফুট । বড়োবাজারে বিলিতি কাপড়ের বিপক্ষে যখন পিকেট করতে বেরিয়েছিলেন, তখন দলের লোক ভক্তি করে তার নাম দিয়েছিল ধ্রুবত্ৰতা । আমার নাম গিরীন্দ্র। দলের লোক আমাকে আমার পত্নীর পতি বলেই জানে, স্বনামের সার্থকতার প্রতি লক্ষ করে না। বিধাতার কৃপায় পৈতৃক উপার্জনের গুণে আমারও কিঞ্চিৎ সার্থকতা আছে। তার প্রতি দলের লোকের দৃষ্টি পড়ে চাঁদা VGIK N3 || স্ত্রীর সঙ্গে স্বামীর স্বভাবের অমিল থাকলেই মিল ভালো হয়, শুকনো মাটির সঙ্গে জলধারার মতো। আমার প্রকৃতি অত্যন্ত টিলে, কিছুই বেশি করে চেপে ধরি নে। আমার স্ত্রীর প্রকৃতি অত্যন্ত আঁট, যা ধরেন তা কিছুতেই ছাড়েন না। আমাদের এই বৈষম্যের গুণেই সংসারে শান্তিরক্ষা হয় । কেবল একটা জায়গায় আমাদের মধ্যে যে-অসামঞ্জস্য ঘটেছে তার আর মিটমাট হতে পারল না । কলিকার বিশ্বাস, আমি স্বদেশকে ভালোবাসি নে । নিজের বিশ্বাসের উপর তার বিশ্বাস অটল- তাই আমার আন্তরিক দেশ-ভালোবাসার যতই প্ৰমাণ দিয়েছি, তাদের নির্দিষ্ট বাহ্য লক্ষণের সঙ্গে মেলে না। বলে কিছুতেই তাকে দেশ-ভালোবাসা বলে স্বীকার করাতে পারি। নে । ছেলেবেলা থেকে আমি গ্রন্থবিলাসী, নতুন বইয়ের খবর পেলেই কিনে আনি । আমার শত্রুরাও কবুল করবে যে, সে বই পড়েও থাকি ; বন্ধুরা খুবই জানেন যে, পড়ে তা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করতেও ছাড়ি নে - সেই আলোচনার চোটে বন্ধুরা পাশ কাটিয়ে চলাতে অবশেষে একটিমাত্র মানুষে এসে ঠেকেছে, বনবিহারী, যাকে নিয়ে আমি রবিবারে আসর জমাই । আমি তার নাম দিয়েছি কোণবিহারী । ছাদে বসে তার সঙ্গে আলাপ করতে করতে এক-একদিন রাত্তির দুটাে হয়ে যায় । আমরা যখন এই নেশায় ভোর তখন আমাদের পক্ষে সুদিন ছিল না। তখনকার পুলিস কারও বাড়িতে গীতা দেখলেই সিডিশনের প্রমাণ পেত । তখনকার দেশভক্ত যদি দেখত কারও ঘরে বিলিতি বইয়ের পাতা কাটা, তবে তাকে জানত দেশবিদ্রোহী। আমাকে ওরা শ্যামবর্ণের প্রলেপ দেওয়া শ্বেত-দ্বৈপায়ন বলেই গণ্য করত। সরস্বতীর বর্ণ সাদা বলেই সেদিন দেশভক্তদের কাছ থেকে তার পূজা মেলা শক্ত হয়েছিল । যে-সরোবরে তার শ্বেতপদ্ম ফোটে সেই সরোবরের জলে দেশের কপাল-পোড়ানো আগুন নেবে না, বরঞ্চ বাড়ে, এমনি একটা রব উঠেছিল । সহধর্মিণীর সদদৃষ্টান্ত ও নিরন্তর তাগিদ সত্ত্বেও আমি খদ্দর পরি নে ; তার কারণ এ নয় যে, খন্দরে কোনো দোষ আছে বা গুণ নেই বা বেশভূষায় আমি শৌখিন । একেবারে উলটাে— স্বদেশিক চালচলনের বিরুদ্ধে অনেক অপরাধ আমার আছে, কিন্তু পরিচ্ছন্নতা তার অন্তৰ্গত নয় । ময়লা মোটা যুগে চীনেবাজারের আগা-চওড়া জুতো পরতুম, সে জুতোয় প্রতিদিন কালিমা-লেপন করিয়ে নিতে ভুলতুম, মোজা পরতে আপদ বোধ হত, শার্ট না পরে পাঞ্জাবি পরতে আরাম পেতুম, আর সেই পাঞ্জাবিতে দুটাে-একটা বোতামের অভাব ঘটলেও খেয়াল করতুম না- ইত্যাদি কারণে কলিকার সঙ্গে আমার সম্পূর্ণ বিচ্ছেদ হবার আশঙ্কা ঘটেছিল। সে বলত “দেখো, তোমার সঙ্গে কোথাও বেরোতে আমার লজা করে ।” আমি বলতুম, “আমার অনুগত হবার দরকার নেই, আমাকে বাদ দিয়েই তুমি বেরিয়ো ।” আজ যুগের পরিবর্তন হয়েছে, আমার ভাগ্যের পরিবর্তন হয় নি। আজও কলিকা বলে, “তোমার সঙ্গে বেরোতে আমার লজ্জা করে ।” তখন কলিকা যে-দলে ছিল তাদের উর্দি আমি ব্যবহার করি নি, আজ যে-দলে ভিড়েছে তাদের উদিও গ্রহণ করতে পারলুম না । আমাকে নিয়ে আমার স্ত্রীর লজ্জা সমানই রয়ে গেল । এটা আমারই স্বভাবের দোষ । যে-কোনো দলেরই হোক, ভেক ধারণ করতে