পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪২২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8○8 রবীন্দ্র-রচনাবলী আমার সংকোচ লাগে। কিছুতেই এটা কাটাতে পারলুম না । অপর পক্ষে মতান্তর জিনিসটা কলিকা খতম করে মেনে নিতে পারে না । কারনার ধারা যেমন মোটা পাথরটাকে বারে বারে ঘুরে ফিরে তর্জন করে বৃথা ঠেলা দিতেই থাকে, তেমনি ভিন্ন রুচিকে চলতে ফিরতে দিনে রাত্রে ঠেলা না দিয়ে কলিকা থাকতে পারে না ; পৃথক মত-নামক পদার্থের সংস্পৰ্শমাত্র ওর স্নায়ুতে যেন দুনির্বারভাবে সুড়সুড়ি লাগায়, ওকে একেবারে ছটফটিয়ে তোলে । কাল চায়ের নিমন্ত্রণে যাবার পূর্বেই আমার নিষখদ্দর বেশ নিয়ে একসহস্র-একতম বার কলিকা যে আলোচনা উত্থাপিত করেছিল, তাতে তার কণ্ঠস্বরে মাধুৰ্যমাত্র ছিল না । বুদ্ধির অভিমান থাকাতে বিনা তর্কে তার ভৎসনা শিরোধাৰ্য করে নিতে পারি নি- স্বভাবের প্রবর্তনায় মানুষকে এত ব্যৰ্থ চেষ্টাতেও উৎসাহিত করে । তাই আমিও একসহস্র-একতম বার কলিকাকে খোটা দিয়ে বললুম, “মেয়েরা, বিধিদত্ত চোখটার উপর কালাপেড়ে মোটা ঘোমটা টেনে আচারের সঙ্গে আঁচলের গাট বেঁধে চলে । মননের চেয়ে মাননেই তাদের আরাম । জীবনের সকল ব্যবহারকেই রুচি ও বুদ্ধির স্বাধীন ক্ষেত্র থেকে সরিয়ে নিয়ে সংস্কারের জেনানায় পর্দানশীন করতে পারলে তারা বঁাচে । আমাদের এই আচারজীৰ্ণ দেশে খন্দর-পরাটা সেইরকম মালাতিলকধারী ধামিকতার মতোই একটা সংস্কারে পরিণত হতে চলেছে বলেই মেয়েদের ওতে এত আনন্দ ।” কলিকা রেগে অস্থির হয়ে উঠল । তার আওয়াজ শুনে পাশের ঘর থেকে দাসীটা মনে করলে, ভাৰ্য্যকে পুরো ওজনের গয়না দিতে কর্তা বুঝি ফাকি দিয়েছে। কলিকা বললে, “দেখো, খদ্দর-পরার শুচিত যেদিন গঙ্গাস্নানের মতোই দেশের লোকের সংস্কারে বাধা পড়ে যাবে সেদিন দেশ বাচাবে । বিচার যখন স্বভাবের সঙ্গে এক হয়ে যায়। তখনই সেটা হয় আচার । চিন্তা যখন আকারে দৃঢ়বদ্ধ হয় তখনই সেটা হয় সংস্কার ; তখন মানুষ চোখ বুজে কাজ করে যায়, চোখ খুলে দ্বিধা করে না ।” এই কথাগুলো অধ্যাপক নয়নমোহনের আগুবাক্য, তার থেকে কোটেশনমার্কা ক্ষয়ে গিয়েছে, কলিকা ওগুলোকে নিজের স্বচিন্তিত বলেই জানে । “বোবার শত্ৰু নেই যে পুরুষ বলেছিল। সে নিশ্চয় ছিল অবিবাহিত । কোনো জবাব দিলুম না দেখে কলিকা দ্বিগুণ বেঁকে উঠে বললে, “বৰ্ণভেদ তুমি মুখে অগ্রাহ্য কর। অথচ কাজে তার প্রতিকারের জন্য কিছুই কর না । আমরা খদ্দর পরে পরে সেই ভেদটার উপর অখণ্ড সাদা রঙ বিছিয়ে দিয়েছি, আবরণভেদ তুলে দিয়ে বৰ্ণভেদটার ছাল ছাড়িয়ে ফেলেছি।” । বলতে যাচ্ছিলুম, “বৰ্ণভেদকে মুখেই অগ্রাহ্য করেছিলুম বটে যখন থেকে মুসলমানের রান্না মুরগির ঝোল গ্রাহ্য করেছিলুম। সেটা কিন্তু মুখস্থ বাক্য নয়, মুখস্থ কাৰ্য- তার গতিটা অন্তরের দিকে । কাপড় দিয়ে বর্ণ-বৈষম্য ঢাকা দেওয়াটা বাহ্যিক ; ওতে ঢাকা দেওয়াই হয়, মুছে দেওয়া হয় না।” তৰ্কটাকে প্রকাশ করে বলবার যোগ্য সাহস কিন্তু হল না। আমি ভীরু পুরুষমানুষ মাত্র, চুপ করে রইলুম । জানি আপসে আমরা দুজনে যে-সব তর্ক শুরু করি কলিকা সেগুলিকে নিয়ে ধোবার বাড়ির কাপড়ের মতো আছড়িয়ে কচলিয়ে আনে তার বাহিরের বন্ধুমহল থেকে । দর্শনের প্রফেসর নয়নমোহনের কাছ থেকে প্রতিবাদ সংগ্রহ করে তার দীপ্ত চক্ষু নীরব ভাষায় আমাকে বলতে থাকে, “কেমন ! জবােদ !” নয়নের ওখানে নিমন্ত্রণে যাবার ইচ্ছা আমার একটুও ছিল না। নিশ্চয় জানি, হিন্দুকালচারে সংস্কার ও স্বাধীন বুদ্ধি, আচার ও বিচারের আপেক্ষিক স্থানটা কী, এবং সেই আপেক্ষিকতায় আমাদের দেশকে অন্য সকল দেশের চেয়ে উৎকর্ষ কেন দিয়েছে, এই নিয়ে চায়ের টেবিলে তপ্ত চায়ের ধোয়ার মতোই সূক্ষ্ম আলোচনায় বাতাস আর্দ্র ও আচ্ছন্ন হবার আশু সম্ভাবনা আছে। এ দিকে সোনালি পত্ৰলেখায় মণ্ডিত অখণ্ডিতপত্ৰবতী নবীন বহিগুলি সদ্য দোকান থেকে আমার তাকিয়ার পাশে প্রতীক্ষা করছে, শুভদৃষ্টিমাত্র হয়েছে, কিন্তু এখনো তাদের ব্ৰাউন মোড়কের অবগুণ্ঠনমোচন হয় নি ; তাদের সম্বন্ধে আমার পূর্বরাগ প্রতি মুহুর্তে অন্তরে অন্তরে প্রবল হয়ে উঠছে। তবু বেরোতে হল ; কারণ ধ্রুবত্রতার ইচ্ছাবেগ প্রতিহত হলে সেটা তার বাক্যে ও অবাক্যে এমন-সকল ঘূণীরূপ ধারণ করে যেটা আমার