পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪২৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 Obr রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী রেখে দাও ।” রেখে দিলুম। গোড়ায় বলাই না। যদি দেখাত। তবে হয়তো। ওটা আমার লক্ষ্যই হত না । কিন্তু, এখন রোজই চোখে পড়ে । বছরখানেকের মধ্যে গাছটা নির্লজের মতো মস্ত বেড়ে উঠল । বলাইয়ের এমন হল, এই গাছটার পরেই তার সব চেয়ে স্নেহ । গাছটাকে প্রতিদিনই দেখাচ্ছে নিতান্ত নির্বোধের মতো । একটা অজায়গায় এসে দাড়িয়ে কাউকে খাতির নেই, একেবারে খাড়া লম্বা হয়ে উঠছে। যে দেখে সেই ভাবে, এটা এখানে কী করতে । আরো দু-চারবার এর মৃত্যুদণ্ডের প্রস্তাব করা গেল । বলাইকে লোভ দেখালুম, এর বদলে খুব ভালো কতকগুলো গোলাপের চারা আনিয়ে দেব । বললেম, “নিতান্তই শিমুলগাছই যদি তোমার পছন্দ, তবে আর-একটা চারা আনিয়ে বেড়ার ধারে পুঁতে দেব, সুন্দর দেখতে হবে।” কিন্তু কাটবার কথা বললেই বলাই আঁতকে ওঠে, আর ওর কাকি বলে, “আহা, এমনিই কী খারাপ দেখতে হয়েছে ।” আমার বউদিদির মৃত্যু হয়েছে। যখন এই ছেলেটি তার কোলে । বোধ করি সেই শোকে দাদার খেয়াল গেল, তিনি বিলেতে এঞ্জিনিয়ারিং শিখতে গেলেন । ছেলেটি আমার নিঃসন্তান ঘরে কাকির কোলেই মানুষ । বছর দশেক পরে দাদা ফিরে এসে বলাইকে বিলাতি কায়দায় শিক্ষা দেবেন বলে প্ৰথমে নিয়ে গেলেন সিমালেয়- তার পরে বিলেত নিয়ে যাবার কথা । কঁদতে কঁদিতে কাকির কোল ছেড়ে বলাই চলে গেল, আমাদের ঘর হল শূন্য । তার পরে দু বছর যায় । ইতিমধ্যে বলাইয়ের কাকি গোপনে চোখের জল মেছেন, আর বলাইয়ের শূন্য শোবার ঘরে গিয়ে তার ছেড়া একপাটি জুতো, তার রবারের ফাটা গোলা, আর জানোয়ারের গল্পওয়ালা ছবির বই নাড়েন-চাড়েন ; এতদিনে এই সব চিহ্নকে ছাড়িয়ে গিয়ে বলাই অনেক বড়ো হয়ে উঠেছে, এই কথা বসে বসে চিন্তা করেন । কোনো এক সময়ে দেখলুম, লক্ষ্মীছাড়া শিমুলগাছটার বড়ো বাড় বেড়েছে- এতদূর অসংগত হয়ে উঠেছে যে, আর প্রশ্রয় দেওয়া চলে না। এক সময়ে দিলুম তাকে কেটে । এমন সময়ে সিমলে থেকে বলাই তার কাকিকে এক চিঠি পাঠালে, “কাকি, আমার সেই শিমুলগাছের একটা ফোটােগ্রাফ পাঠিয়ে দাও।” বিলেত যাবার পূর্বে একবার আমাদের কাছে আসবার কথা ছিল, সে আর হল না । তাই বলাই তার বন্ধুর ছবি নিয়ে যেতে চাইলে । তার কাকি আমাকে ডেকে বললেন, “ওগো শুনছ, একজন ফোটােগ্রাফওয়ালা ডেকে আনে ৷” জিজ্ঞাসা করলুম, “কেন।” বলাইয়ের কাচা হাতের লেখা চিঠি আমাকে দেখতে দিলেন । আমি বললেম, “সে গাছ তো কাটা হয়ে গেছে ।” বলাইয়ের কাকি দুদিন অন্ন গ্ৰহণ করলেন না, আর অনেকদিন পর্যন্ত আমার সঙ্গে একটি কথাও কন নি। বলাইয়ের বাবা ওকে তার কোল থেকে নিয়ে গেল, সে যেন ওঁর নাড়ি ছিড়ে ; আর ওর কাকা তার বলাইয়ের ভালোবাসার গাছটিকে চিরকালের মতো সরিয়ে দিলে, তাতেও ওঁর যেন সমস্ত সংসারকে বাজল, তার বুকের মধ্যে ক্ষত করে দিলে । ঐ গাছ যে ছিল তার বলাইয়ের প্রতিরূপ, তারই প্ৰাণের দোসর । veisaksi Svooc