পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৩১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

?Ş९७फ्र 8 Ꭹ Ꮤ2 বাবা ছিলেন কোনো নামজাদা ব্যাঙ্কের অন্যতম অধিনায়ক, তারই একজন অংশীদার হলোম আমি । যাকে বলে ঘুমিয়ে-পড়া অংশীদার একেবারেই তা নয়। আষ্ট্রেপৃষ্টে লাগাম দিয়ে জুতে দিলে আমাকে আপিসের কাজে । আমার শরীরমনের সঙ্গে এই কাজটা মানানসই নয় । ইচ্ছা ছিল, ফরেস্ট বিভাগে কোথাও পরিদর্শকের পদ দখল করে বসি, খোলা হাওয়ায় দীেড়ধাপ করি, শিকারের শখ নিই মিটিয়ে । বাবা তাকালেন প্ৰতিপত্তির দিকে ; বললেন, যে-কাজ পাচ্ছি সেটা সহজে জোটে না বাঙালির ভাগ্যে । হার মানতে হল । তা ছাড়া মনে হয়, পুরুষের প্রতিপত্তি জিনিসটা মেয়েদের কাছে দামি। সুনেত্রার ভগ্নীপতি অধ্যাপক ; ইস্পীরিএল সার্ভিস তার, সেটাতে ওদের মেয়েমহলের মাথা উপরে তুলে রাখে । যদি জংলি, “নিসাপেকেট্টর সাহেব হয়ে সোলার হ্যাট পরে বাঘ-ভালুকের চামড়ায় মেঝে দিতুম ঢেকে, তাতে আমার দেহের গুরুত্ব কমিয়ে রাখত, সেইসঙ্গে কমাত আমার পদের গৌরব আর-পাচজন পদস্থ প্রতিবেশীর তুলনায়। কী জানি, এই লাঘবতায় মেয়েদের আত্মাভিমান বুঝি কিছু ক্ষুন্ন করে । এ দিকে ডেস্কে-বাধা স্থাবরত্বের চাপে দেখতে দেখতে আমার যৌবনের ধার আসছে। ভেঁাতা হয়ে । অন্য-কোনো পুরুষ হলে সে কথাটা নিশ্চিন্ত মনে ভুলে গিয়ে পেটের পরিধিবিস্তারকে দুর্বিপাক বলে গণ্য করত না । আমি তা পারি নে। আমি জানি, সুনেত্ৰা মুগ্ধ হয়েছিল শুধু আমার গুণে নয়, আমার দেহসৌষ্ঠবে । বিধাতার স্বরচিত যে-বরমাল্য অঙ্গে নিয়ে একদিন তাকে বরণ করেছি। নিশ্চিত তার প্রয়োজন আছে প্রতিদিনের অভ্যর্থনায় । আশ্চর্য এই যে, সুনেত্রার যৌবন আজও রইল অক্ষুন্ন, দেখতে দেখতে আমিই চলেছি। ভাটার মুখে- শুধু ব্যাঙ্কে জমছে টাকা । আমাদের মিলনের প্রথম অভ্যুদয়কে আর-একবার প্রত্যক্ষ চোখের সামনে আনল আমার মেয়ে অরুণা । আমাদের জীবনের সেই উষারুণরাগ দেখা দিয়েছে ওদের তারুণ্যের নবপ্ৰভাতে । দেখে পুলকিত হয়ে ওঠে আমার সমস্ত মন । শৈলেনের দিকে চেয়ে দেখি, আমার সেদিনকার বয়স ওর দেহে আবির্ভূত। যৌবনের সেই ক্ষিপ্ৰশক্তি, সেই অজস্র প্রফুল্লতা, আবার ক্ষণে ক্ষণে প্ৰতিহত দুরাশায় স্নানায়মান উৎসাহের উৎকণ্ঠা। সেই দিন আমি যে-পথে চলতেম। সেই পথ ওরও সামনে, তেমনি করেই অরুণার মায়ের মন বশ করবার নানা উপলক্ষ ও সৃষ্টি করছে, কেবল যথেষ্ট লক্ষ্যগোচর নই। আমিই । অপর পক্ষে অরুণা জানে মনে মনে, তার বাবা বোঝে মেয়ের দরদ । এক-একদিন কী জানি কেন দুই চক্ষে অদৃশ্য অশ্রুর করুণা নিয়ে চুপ করে এসে বসে আমার পায়ের কাছের মোড়ায় । ওর মা নিষ্ঠুর হতে পারে, আমি পারি। নে । অরুণার মনের কথা ওর মা যে বোঝে না তা নয় ; কিন্তু তার বিশ্বাস, এ সমস্তই ‘প্ৰভাতে মেঘডম্বরম, বেলা হলেই যাবে মিলিয়ে । ঐখানেই সুনেত্রার সঙ্গে আমার মতের অনৈক্য। খিদে মিটতে না দিয়ে খিদে মেরে দেওয়া যায় না তা নয়, কিন্তু দ্বিতীয়বার যখন পাত পড়বে তখন হৃদয়ের রাসনায় নবীন ভালোবাসার স্বাদ যাবে মরে । মধ্যাহ্নে ভোরের সুর লাগাতে গেলে আর লাগে না । অভিভাবক বলেন, বিবেচনা করবার বয়েস হােক আগে, তার পরে ইত্যাদি । হায় রে, বিবেচনা করবার বয়েস ভালোবাসার বয়েসের উলটাে পিঠে । কয়েকদিন আগেই এসেছিল “ভরা বােদর মাহ ভাদরী । ঘনবর্ষণের আড়ালে কলকাতার ইটকাঠের বাড়িগুলো এল মোলায়েম হয়ে, শহরের প্রখর মুখরতা অশ্রুগদগদ কণ্ঠস্বরের মতো হল বাষ্পাকুল । ওর মা জানত অরুণা আমার লাইব্রেরি-ঘরে পরীক্ষার পড়ায় প্রবৃত্ত । একখানা বই আনতে গিয়ে দেখি, মেঘাচ্ছন্ন দিনান্তের সজল ছায়ায় জানলার সামনে সে চুপ করে বসে ; তখনো চুল বাধে নি, পূবে হাওয়ায় বৃষ্টির ছাঁট এসে লাগছে তার এলোচুলে । সুনেত্রাকে কিছু বললেম না। তখনই শৈলেনকে লিখে দিলেম চায়ের নিমন্ত্ৰণ চিঠি । পাঠিয়ে দিলেম আমার মোটরগাড়ি ওদের বাড়িতে। শৈলেন এল, তার অকস্মাৎ আবির্ভাব সুনেত্রার পছন্দ নয়, সেটা বোঝা কঠিন ছিল না। আমি শৈলেনকে বললেম, “গণিতে আমার যেটুকু দখল তাতে হাল