পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৫৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সাহিত্যের পথে 8○○ প্রকাশটা একটা ঐশ্বর্যের কথা। যেখানে মানুষ দীন সেখানে তো প্রকাশ নেই, সেখানে সে যা আনে তাই খায়। যাকে নিজেই সম্পূর্ণ শোষণ করে নিয়ে নিঃশেষ না করতে পারি, তাই দিয়েই তো প্ৰকাশ । লোহা গরম হতে হতে যতক্ষণ না দীপ্ত তাপ পর্যন্ত যায় ততক্ষণ তার প্রকাশ নেই। আলো হচ্ছে তাপের ঐশ্বৰ্য । মানুষের যে-সকল ভােব স্বকীয় প্রয়োজনের মধ্যেই ভুক্ত হয়ে না যায়, যার প্রাচুর্যকে আপনার মধ্যেই আপনি রাখতে পারে না, যা স্বভাবতই দীপ্যমান তারই দ্বারা মানুষের প্রকাশের উৎসব। টাকার মধ্যে এই ঐশ্বৰ্য আছে কোনখানে । যেখানে সে আমার একান্ত প্রয়োজনকে উত্তীর্ণ হয়ে যায়, যেখানে সে আমার পকেটের মধ্যে প্রচ্ছন্ন নয়, যেখানে তার সমস্ত রশ্মিই আমার কৃষ্ণবর্ণ অহংটার দ্বারা সম্পূৰ্ণ শোষিত না হয়ে যাচ্ছে, সেইখানেই তার মধ্যে অশেষের আবির্ভাব এবং এই অশেষই নানারূপে প্ৰকাশমান । সেই প্রকাশের প্রকৃতিই এই যে, আমরা সকলেই বলতে পারি- “এ যে আমার । সে যখন অশেষকে স্বীকার করে তখনই সে কোনো একজন অমুক বিশেষ লোকের ভোগ্যতার মলিন সম্বন্ধ হতে মুক্ত হয়। অশেষের প্রসাদ-বঞ্চিত সেই বিশেষভোগ্য টাকার বর্বরতায় বসুন্ধরা পীড়িত ৷ দৈন্যের ভরের মতো আর ভার নেই। টাকা যখন দৈন্যের বাহন হয় তখন তার চাকার তলায় কত মানুষ ধূলিতে ধূলি হয়ে যায়। সেই দৈন্যেরই নাম প্ৰতাপ, তা আলোক নয়, তা কেবলমাত্র দাহ- সে যার কেবলমাত্র তারই, এইজন্যে তাকে অনুভব করা যায় কিন্তু স্বীকার করা যায় না । নিখিলের সেই স্বীকার-কারাকেই বলে প্ৰকাশ । এই প্ৰতাপের রক্তপঙ্কিল অশুচি স্পর্শকে প্রকৃতি তার শ্যামল অমৃতের ধারা দিয়ে মুছে মুছে দিচ্ছে। ফুলগুলি সৃষ্টির অন্তঃপুর থেকে সৌন্দর্যের ডালি বহন করে নিয়ে এসে প্ৰতাপের কলুষিত পদচিহ্নগুলোকে লজ্জায় কেবলই ঢাকা দিয়ে দিয়ে চলেছে । জানিয়ে দিচ্ছে যে, “আমরা ছোটাে, আমরা কোমল, কিন্তু আমরাই চিরকালের । কেননা, সকলেই আমাদের বরণ ক’রে নিয়েছে- আর, ঐ-যে উদ্যতমুষ্টি বিভীষিকা, যে পাথরের পরে পাথর চাপিয়ে আপনার কেল্লাকে অভ্ৰভেদী ক’রে তুলছে সে কিছুই নয়, কেননা ওর নিজে ছাড়া আর কেউই ওকে স্বীকার করছে না- মাধবীবিতানের সুন্দরী ছায়াটিও ওর চেয়ে সত্য ।” এই-যে তাজমহল- এমন’। তাজমহল, তার কারণ সাজাহানের হৃদয়ে তার প্ৰেম, তার বিরহবেদনার আনন্দ অনন্তকে স্পর্শ করেছিল ; তার সিংহাসনকে তিনি যে কোঠাতেই রাখুন। তিনি তার তাজমহলকে তার আপনি থেকে মুক্ত করে দিয়ে গেছেন। তার আর আপন-পর নেই, সে অনন্তের বেদি । সাজাহানের প্রতাপ যখন দস্যবৃত্তি করে তখন তার লুঠের মাল যতই প্ৰভূত হােক তাতে ক’রে তার নিজের থলিটারও পেট ভরে না, সুতরাং ক্ষুধার অন্ধকারের মধ্যে তলিয়ে লুপ্ত হয়ে যায়। আর, যেখানে পরিপূর্ণতার উপলব্ধি তার চিত্তে আবির্ভূত হয় সেখানে সেই দৈববাণীটিকে নিজের কোষাগারে নিজের বিপুল রাজ্যে সাম্রাজ্যে কোথাও সে আর ধরে রেখে দিতে পারে না । সর্বজনের ও নিত্যকালের হাতে তাকে সমৰ্পণ করা ছাড়া আর গতি নেই। একেই বলে প্ৰকাশ । আমাদের সমস্ত মঙ্গল-অনুষ্ঠানে গ্ৰহণ করবার মন্ত্র হচ্ছে ওঁ- অর্থাৎ, হঁহা । তাজমহল হচ্ছে সেই নিত্য-উচ্চারিত ওঁনিখিলের সেই গ্ৰহণ-মন্ত্র মূর্তিমান । সাজাহানের সিংহাসনে সেই মন্ত্র পড়া হয় নি ; একদিন তার যতই শক্তি থাক-না কেন, সে তো 'না' হয়ে কোথায় তলিয়ে গেল। তেমনি কত কত বড়ো বড়ো নামধারী 'না'এর দল আজ দম্ভভরে বিলুপ্তির দিকে চলেছে, তাদের কামানগর্জিত ও বন্দীদের শৃঙ্খল-ঝংকৃত কলরবে কান বধির হয়ে গেল, কিন্তু তার মায়া, তারা নিজেরই মৃত্যুর নৈবেদ্য নিয়ে কালরাত্রিপারাবারের কালীঘাটে সব যাত্রা করে চলেছে । কিন্তু, ঐ সাজাহানের কন্যা জাহানারার একটি কান্নার গান ? তাকে নিয়ে আমরা বলেছি, ওঁ । কিন্তু, আমরা দান করতে চাইলেই কি দান করতে পারি। যদি বলি, “তুভ্যমহং সম্প্রদাদে’, তা হলেই কি বর এসে হাত পাতেন । নিত্যকাল এবং নিখিলবিশ্ব এই কথাই বলেন- “যদেতৎ হৃদয়ং মম তার সঙ্গে তোমার সম্প্রদানের মিল থাকা চাই। তোমার অনন্তম যা দেবেন। আমি তাই নিতে পারি। তিনি মেঘদূতকে নিয়েছেন- তা উজ্জয়িনীর বিশেষ সম্পত্তি না, তাকে বিক্ৰমাদিত্যের সিপাই