পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৬১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সাহিত্যের পথে 88\○ তাকে বরমাল্য দিলেও রসজ্ঞ তাকে বর্জন করেন । জাপানি কোনো ওস্তাদের ছবিতে দেখেছিলুম, একটি মূর্তির সামনে সূর্য কিন্তু পিছনে ছায়া নেই। এমন অবস্থায় যে লম্বা ছায়া পড়ে, এ কথা শিশুও জানে । কিন্তু বস্তুবিদ্যার খবর দেবার জন্যে তো ছবির সৃষ্টি নয় । কলা-রচনাতেও যারা ভয়ে ভয়ে তথ্যের মজুরি করে তারা কি ওস্তাদ । অতএব, রূপের মহলে রসের সত্যকে প্রকাশ করতে গেলে, তথ্যের দাসখত থেকে মুক্তি নিতে হয় । একটা ছেলে-ভোলানো ছড়া থেকে এর উদাহরণ দিতে চাই 6२ ७ ८: লাল জুতুয়া পায়ে । জুতা জিনিসটা তথ্যের কোঠায় পড়ে, এ সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না । চীনে মুচির দোকানে নগদ কড়ি দিলেই মাপসই জুতা পছন্দসই আকারে পেতে সবাই পারে। কিন্তু, জুতুয়া ? চীনেম্যান দূরে থাক, বিলিতি দোকানের বড়ো ম্যানেজারও তার খবর রাখে না । জুতুয়ার খবর রাখে। মা, আর রাখে খোকা । এইজন্যই এই সত্যটিকে প্রকাশ করতে হবে বলে জুতা শব্দের ভদ্রতা নষ্ট করতে হল । তাতে আমাদের শব্দাম্বুধি বিক্ষুব্ধ হতে পারে, কিন্তু তথ্যের জুতা সত্যের মহলে চলে না। ব’লেই ব্যাকরণের আক্রোশকেও উপেক্ষা করতে হয় । কবিতা যে-ভাষা ব্যবহার করে সেই ভাষার প্রত্যেক শব্দটির অভিধাননির্দিষ্ট অর্থ আছে । সেই বিশেষ অর্থেই শব্দের তথ্যসীমা । এই সীমাকে ছাড়িয়ে শব্দের ভিতর দিয়েই তো সত্যের অসীমতাকে প্ৰকাশ করতে হবে । তাই কত ইশারা, কত কৌশল, কত ভঙ্গি । জ্ঞানদাসের একটি পদ মনে পড়ছে রূপের পাথরে আঁখি ডুবিয়া রহিল, যৌবনের বনে মন পথ হারাইল । তথ্যবাগীশ এই কবিতা শুনে কী বলবেন । ডুবেই যদি মরতে হয় তো জলের পাথার আছে ; রূপের পাথার বলতে কী বোঝায় । আর, চোখ যদি ডুবেই যায়। তবে রূপ দেখবে কী দিয়ে । আবার যৌবনের বন কোন দেশের বন । সেখানে পথ পায়ই বা কে আর হারায়ই বা কী উপায়ে। র্যারা তথ্য খোজেন তাদের এই কথাটা বুঝতে হবে যে, নির্দিষ্ট শব্দের নির্দিষ্ট অর্থ যে-তথ্যের দুর্গ ফেদে বসে আছে। ছলে বলে কৌশলে তারই মধ্যে ছিদ্র করে নানা ফাকে, নানা আড়ালে সত্যকে দেখাতে হবে । দুর্গের পাথরের গাথুনি দেখাবার কাজ তো কবির নয় । যারা তথ্যের দিকে দৃষ্টি রাখে তাদের হাতে কবিদের কী দুৰ্গতি ঘটে তার একটা দৃষ্টান্ত দিই। আমি কবিতায় একটি বৌদ্ধকাহিনী লিখেছিলেম । বিষয়টি হচ্ছে এই:- একদা প্ৰভাতে অনাথাপিণ্ডদ প্ৰভু বুদ্ধের নামে শ্রাবন্তীনগরের পথে ভিক্ষা মেগে চলেছেন । ধনীরা এনে দিলে ধন, শ্ৰেষ্ঠীরা এনে দিলে রত্ন, রাজঘরের বধুরা এনে দিলে হীরামুক্তার কণ্ঠী । সব পথে পড়ে রইল, ভিক্ষার ঝুলিতে উঠল না । বেলা যায়, নগরের বাহিরের পথের ধারে গাছের তলায় অনাথাপিণ্ডদ দেখলেন এক ভিক্ষুক মেয়ে । তার আর কিছুই নেই, গায়ে একখানি জীৰ্ণ চীর । গাছের আড়ালে দাড়িয়ে এই মেয়ে সেই চীরখানি প্রভুর নামে দান করলে । অনাথাপিণ্ডদ বললেন, “অনেকে অনেক দিয়েছে, কিন্তু সব তো কেউ দেয় নি । এতক্ষণে আমার প্রভুর যোগ্য দান মিলল, আমি ধন্য হলুম।” একজন প্ৰবীণ বিজ্ঞা ধামিক খ্যাতিমান লোক এই কবিতা পড়ে বড়ো লজ্জা পেয়েছিলেন ; বলেছিলেন, “এ তো ছেলেমেয়েদের পড়বার যোগ্য কবিতা নয় ।” এমনি আমার ভাগ্য, আমার খোড়া কলম খানার মধ্যে পড়তেই আছে। যদি-বা বৌদ্ধধর্মগ্রন্থ থেকে আমার গল্প আহরণ করে আনলুম, সেটাতেও সাহিত্যের আবু নষ্ট হল । নীতিনিপুণের চক্ষে তথ্যটাই বড়ো হয়ে উঠল, সত্যটা ঢাকা পড়ে গেল । হায় রে কবি, একে তো ভিখারিনীর কাছ থেকে দান নেওয়াটাই তথ্য হিসাবে অধম, তার পরে নিতান্ত নিতেই যদি হয় তা হলে তার পাতার কুঁড়ের ভাঙা বঁ্যাপটা কিংবা একমাত্র মাটির হাড়িটা নিলে তো সাহিত্যের স্বাস্থ্যরক্ষা হতে পারত। তথ্যের দিক থেকে এ কথা নতশিরে মানতেই হবে । 9 SSRİ SSRRə