পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৬২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

888 রবীন্দ্র-রচনাবলী এমন-কি, আমার মতো কবি যদি তথ্যের জগতে ভিক্ষা করতে বেরত তবে কখনোই এমন গৰ্হিত কাজ করত না এবং তথ্যের জগতের পাগলাগারদের বাইরে এমন ভিক্ষুক মেয়ে কোথাও মিলত না রাস্তার ধারে নিজের গায়ের একখানিমাত্র কাপড় যে ভিক্ষা দিত ; কিন্তু, সত্যের জগতে স্বয়ং ভগবান বুদ্ধের প্রধান শিষ্য এমন ভিক্ষা নিয়েছেন এবং ভিখারিনী এমন অদ্ভুত ভিক্ষা দিয়েছে ; এবং তার পরে সে মেয়ে যে কেমন ক’রে রাস্তা দিয়ে ঘরে ফিরে যাবে সে তর্ক সেই সত্যের জগৎ থেকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তথ্যের এতবড়ো অপলাপ ঘটে, ও সত্যের কিছুমাত্র খর্বত হয় না- সাহিত্যের ক্ষেত্রটা এমনি । রসবস্তুর এবং তথ্যবস্তুর এক ধর্ম এবং এক মূল্য নয়। তথ্যজগতের যে আলোকরশ্মি দেয়ালে এসে ঠেকে যায়, রসজগতে সে রশ্মি স্থূলকে ভেদ ক’রে অনায়াসে পার হয়ে যায় ; তাকে মিস্ত্রি ডাকতে বা সিদ্ধ কাটতে হয় না। রসজগতে ভিখারির জীৰ্ণ চীরখানা থেকেও নেই, তার মূল্যও তেমনি লক্ষপতির সমস্ত ঐশ্বর্যের চেয়ে বড়ো । এমনি উলটাে-পালটা কাণ্ড । তথ্যজগতে একজন ভালো ডাক্তার সব হিসাবেই খুব যোগ্য ব্যক্তি । কিন্তু, তার পয়সা এবং পসার যতই অপৰ্যাপ্ত হোক-না কেন, তার উপরে চোেদ লাইনের কবিতা লেখাও চলে না । নিতান্ত যে উমেদার সে যদি-বা লিখে বসে তা হলে বড়ো ডাক্তারের সঙ্গে যোগ থাকা সত্ত্বেও চােদ্দ দিনও সে কবিতার আয়ুরক্ষা হয় না । অতএব, রসের জগতের আলোকরশ্মি এতবড়ো ডাক্তারের মধ্য দিয়েও পার হয়ে যায় । কিন্তু, এই ডাক্তারকে যে তার সমস্ত প্ৰাণমন দিয়ে ভালোবেসেছে তার কাছে ডাক্তার রস বস্তু হয়ে প্ৰকাশ পায় । হবামাত্র ডাক্তারকে লক্ষ্য ক’রে তার প্ৰেমাসক্ত অনায়াসে বলতে পারে জনম অবধি হাম রূপ নেহারানু নয়ন ন তিরপিত ভেল, লাখ লাখ যুগ হিয়ে হিয়ে রাখানু, তবু হিয়ে জুড়ন না গেল । আঙ্কিক বলছেন, লাখ লাখ যুগ পূর্বে ডারুয়িনের মতে ডাক্তারের পূর্বতন সত্তা যে কী ছিল সে কথা উত্থাপন করা নীতিবিরুদ্ধ না হলেও রুচিবিরুদ্ধ । যা হােক, সোজা কথা হচ্ছে, ডাক্তারের কুষ্ঠিতে লাখ লাখ যুগের অঙ্কপাত হতেই পারে না । তর্ক করা মিছে, কারণ শিশুও এ কথা জানে। ডাক্তার যে সে তো সেদিন জন্মেছে ; কিন্তু বন্ধু যে সে নিত্যকালের হৃদয়ের ধন । সে যে কোনো-এক কালে ছিল না, আর কোনো-এক কালে থাকবে না, সে কথা মনেও করতে পারি। নে । জ্ঞানদাসের দুটি পঙক্তি মনে পড়ছে এক দুই গণইতে অন্ত নাহি পাই, রূপে গুণে রসে প্রেমে আরতি বাঢ়াই । এক-দুইয়ের ক্ষেত্র হল বিজ্ঞানের ক্ষেত্র । কিন্তু, রসসত্যের ক্ষেত্রে যে-প্ৰাণের আরতি বাড়তে থাকে সে তো অঙ্কের হিসাবে বাড়ে না । সেখানে এক-দুইয়ের বালাই নেই, নামতার দৌরাত্ম্য নেই । অতএব, কাব্যের বা চিত্রের ক্ষেত্রে যারা সাৰ্ভে-বিভাগের মাপকাঠি নিয়ে সত্যের চার দিকে তথ্যের সীমানা ঐকে পাকা পিলপে গেথে তুলতে চায়, গুণীরা চিরকাল তাদের দিকে তাকিয়ে বিধাতার কাছে দরবার করেছে।-- ইতর তাপশতানি যথেচ্ছয়া বিতর তানি সহে চতুরানন । অরসিকেষু রসস্য নিবেদনং শিরসি মা লিখ, মা লিখ, মা লিখি । বিধি হে, যত তাপ মাের দিকে হানিবে, অবিচল রব তাহে। রসের নিবেদন অরসিকে ললাটে লিখে না হে, লিখো না হে || Šმiხმf Y\ტ\ტა