পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৬৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

88心 রবীন্দ্র-রচনাবলী মিলে যদি দশাবতারের সুনিপুণ বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বা গীতার শ্লোক থেকে দেশাত্মবোধের আশ্চর্য অর্থ উদঘাটন করতে পারে, তবু তাদের কেউ বাচাতে পারবে না । শুধু কেবল মানুষ কেন, অজীব সামগ্ৰীকে যখন আমরা কাব্যকলার রথে তুলে তথ্যসীমার বাহিরে নিয়ে যাই তখন সত্যের মূল্যে সে মূল্যবান হয়ে ওঠে । কলকাতায় আমার এক কাঠা জমির দাম পাঁচ-দশ হাজার টাকা হতে পারে, কিন্তু সত্যের রাজত্বে সেই দামকে আমরা দাম বলেই মানি নে- সে দাম সেখানে টুকরো টুকরো হয়ে ছিড়ে যায়। বৈষয়িক মূল্য সেখানে পরিহাসের দ্বারা অপমানিত । নিত্যলোকে রসলোকে তথ্যবন্ধন থেকে মানুষের এই-যে মুক্তি এ কি কম মুক্তি । এই মুক্তির কথা আপনাকে আপনি স্মরণ করিয়ে দেবার জন্যে মানুষ গান গেয়েছে, ছবি এঁকেছে; আপনি সত্য ঐশ্বৰ্যকে হাটবাজার থেকে বাচিয়ে এনে সুন্দরের নিত্য ভাণ্ডারে সাজিয়ে রেখেছে ; তার নিকড়িয়া ধনকে নিকড়িয়া বাঁশির সুরে গেঁথে রেখেছে। আপনাকে আপনি বার বার বলেছে, “ঐ আনন্দলোকেই তোমার সত্য প্ৰকাশ ।” আমি কী বোঝােব তোমাদের কাকে বলে সাহিত্য, কাকে বলে চিত্রকলা । বিশ্লেষণ করে কি এর মর্মে গিয়ে পৌঁছতে পারি। কোন আদি উৎস থেকে এর স্রোতের ধারা বাহির হয়েছে এক মুহুর্তে তা বোঝা যায়, যখন সেই স্রোতে মন আপনার গা ভাসিয়ে দেয় । আজ সেই বাশির সুরে যখন মন ভেসেছিল তখন বুঝেছিলেম, বুঝিয়ে দেবার কথা এর মধ্যে কিছু নেই ; এর মধ্যে ডুব দিলেই সব সহজ হয়ে আসে । নীলাকাশের ইশারা আমাদের প্রতিদিন বলেছে, “আনন্দধামের মাঝখানে তোমাদের প্ৰত্যেকের নিমন্ত্ৰণ ।” এ কথা বলেছে, বসন্তের হাওয়ায় বিরহের মরমিয়া কবি । সকালবেলায় প্রভাতকিরণের দূত এসে ধাক্কা দিল। কী । না, নিমন্ত্রণ আছে। উদাস মধ্যাহ্নে মধুকরগুঞ্জিত বনচ্ছায়া দূত হয়ে এসে ধাক্কা দিল, নিমন্ত্রণ আছে। সন্ধ্যামেঘে অন্তসূর্যােচ্ছটায় সে দূত আবার বললে, নিমন্ত্রণ আছে । এত সাজসজা এই দূতের, এত ফুলের মালা এত গৌরবের মুকুট । কার জন্যে । আমার জন্যে । আমি রাজা নাই, জ্ঞানী নই, গুণী নই- আমি সত্য, তাই আমার জন্যে সমস্ত আকাশের রঙ নীল করে, সমস্ত পৃথিবীর আঁচল শ্যামল করে, সমস্ত নক্ষত্রের অক্ষর উজ্জ্বল করে আহবানের বাণী মুখরিত। এই নিমন্ত্রণের উত্তর দিতে হবে না কি । সে উত্তর ঐ আনন্দধামের বাণীতেই যদি না লিখি তা হলে কি গ্রাহ্য হবে । মানুষ তাই মধুর করেই বললে, “আমার হৃদয়ের তারে তোমার নিমন্ত্রণ বাজল । রূপে বাজল, ভাবনায় বাজল, কর্মে বাজল ; হে চিরসুন্দর, আমি স্বীকার করে নিলেম । আমিও তেমনি সুন্দর করে তোমাকে চিঠি পাঠাব, যেমন করে তুমি পাঠালে। যেমন তুমি তোমার অনির্বাণ তারকার প্রদীপ জেলে তোমার দূতের হাতে দিয়েছ, আমাকেও তেমনি করে আলো জ্বালাতে হবে যে-আলো নেবে না, মালা গাঁথতে হবে যো-মালা শুকোতে জানে না । আমি মানুষ, আমার ভিতর যদি অনন্তের শক্তি থাকে। তবে সেই শক্তির ঐশ্বৰ্য দিয়েই তোমার আমন্ত্রণের উত্তর দেব।” মানুষ এমন কথা সাহস করে বলেছে, এতেই তার সকলের চেয়ে বড়ো গীেরব । আজ যখন আমাদের গলিতে বরবধুর সত্যস্বরূপ অৰ্থাৎ আনন্দস্বরূপ প্ৰকাশ করবার ভার নিলে ঐ বাশি, তখন আমি নিজেকে জিজ্ঞাসা করলেম, কী মন্ত্রে বঁাশি আপনার কাজ সমাধা করে । আমাদের তত্ত্বজ্ঞানী তো বলে, অনিশ্চিতের দোলায় সমস্ত সংসার দোদুল্যমান; বলে, যা দেখ কিছুই সত্য নয়। আমাদের নীতিনিপুণ বলে, ঐ-যে ললাটে ওরা চন্দন পরেছে, ও তো ছলনা, ওর ভিতর আছে মাথার খুলি । ঐ-যে মধুর হাসি দেখতে পােচ্ছ, ঐ হাসির পর্দা তুলে দেখো, বেরিয়ে পড়বে শুকনো দাতের পাটি । বাশি তর্ক ক'রে তার কোনো জবাব দেয় না ; কেবল তার খাম্বাজের সুরে বলতে থাকে, খুলি বল, দাঁতের পাটি বল, যত কালই টিকে থাক-না কেন, ওরা মিছে ; কিন্তু ললাটে যে আনন্দের সুগন্ধ লিপি আছে, মুখে যে লজার হাসির আভা দিচ্ছে, যা এখন আছে তখন নেই, যা ছায়ার মতো মায়ার মতো, যাকে ধরতে গেলে ধরা যায় না, তাই সত্য, করুণ সত্য, মধুর সত্য, গভীর সত্য । সেই সত্যকেই সংসারের সমস্ত আনাগোনার উপরে উজ্বল ক’রে ধরে বঁাশি বলছে, “সত্যকে যেদিন প্ৰত্যক্ষ দেখবে সেই দিনই উৎসব ।”