পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৭৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

86 by রবীন্দ্ৰ-রচনাৱলী কেন থাকবে, এমন একটা প্রশ্ন পরম্পরায় কানে উঠল । এমন কথারও কি উত্তর দেওয়ার দরকার আছে। যারা তুরীয় অবস্থায় উঠেছেন তাদের কাছে সাহিত্যও নেই, আর্টও নেই ; তাদের কথা ছেড়েই দেওয়া যায়। কিন্তু, কিছুর সঙ্গে কিছুরই মূল্যভেদ যদি সাহিত্যেও না থাকে তা হলে পৃথিবীতে সকল লেখাই তো সমান দামের হয়ে ওঠে । কেননা, অসীমের মধ্যে নিঃসন্দেহই তাদের সকলেরই এক অবস্থা- খণ্ড দেশকালপাত্রের মধ্যেই তাদের মূল্যভেদ । আমি এবং মাকাল অসীমের মধ্যে একই, কিন্তু আমরা খেতে গেলেই দেখি তাদের মধ্যে অনেক প্ৰভেদ । এইজন্যে অতি বড়ো তত্ত্বজ্ঞানী অধ্যাপকদেরও যখন ভোজে নিমন্ত্ৰণ করি তখন তাদের পাতে আমের অকুলোন হলে মাকাল দিতে পারি নে। তত্ত্বজ্ঞানের দোহাই পেড়ে মাকাল যদি দিতে পারতুম এবং দিয়ে যদি বাহবা পাওয়া যেত, তা হলে সন্তায় ব্রাহ্মণভোজন করানো যেত, কিন্তু পুণ্য খতিয়ে দেখবার বেলায় চিত্রগুপ্ত নিশ্চয় পাতঞ্জলদর্শনের মতে হিসাব করতেন না । পুণ্যলাভ করতে শক্তির দরকার। সাহিত্যেও একটা পুণ্যের খাতা খোলা আছে। ভালোরকম বিদ্যাশিক্ষার জন্যে মানুষকে নিয়ত যে-প্ৰয়াস করতে হয় সেটাতে মস্তিষ্কের ও চরিত্রের শক্তি চাই । সমাজে এই বিদ্যাশিক্ষার বিশেষ একটা আদর আছে বলেই সাধারণত এত ছাত্র এতটা শক্তি জাগিয়ে রাখে । সেই সমাজই যদি কোনো কারণে কোনো একদিন বলে বসে বিদ্যাশিক্ষা ত্যাগ করাটাই আদরণীয়, তা হলে অধিকাংশ ছাত্র অতি সহজেই সাহস প্ৰকাশ করবার অহংকার করতে পারে । এইরকম সপ্তা বীরত্ব করবার উপলক্ষ সাধারণ লোককে দিলে তাদের কর্তব্য বুদ্ধিকে দুর্বল করাই হয় । বীর্যসাধ্য সাধনা বহুকাল বহু লোকেই অবলম্বন করেছে বলে তাকে সামান্য ও সেকেলে বলে উপেক্ষা করবার স্পর্ধ একবার প্রশ্রয় পেলে অতি সহজেই তা সংক্রামিত হতে পারেবিশেষভাবে, যারা শক্তিহীন তাদেরই মধ্যে। সাহিত্যে এইরকম কৃত্রিম দুঃসাহসের হওয়া যদি ওঠে তা হলে বিস্তর অপটু লেখকের লেখনী মুখর হয়ে উঠবে, এই আমাদের আশঙ্কা । আমি দেখেছি। কেউ কেউ বলছেন, এই-সব তরুণ লেখকের মধ্যে নৈতিক চিত্তবিকার ঘটেছে ব’লেই এইরকম সাহিত্যের সৃষ্টি হঠাৎ এমন দ্রুতবেগে প্রবল হয়ে উঠেছে। আমি নিজে তা বিশ্বাস করি না । এঁরা অনেকেই সাহিত্যে সহজিয়া সাধন গ্ৰহণ করেছেন, তার প্রধান কারণ এটাই সহজ । অথচ দুঃসাহসিক বলে এতে বাহবাও পাওয়া যায়, তরুণের পক্ষে সেটা কম প্রলোভনের কথা নয়। তারা বলতে চায় “আমরা কিছু মানি নো- এটা তরুণের ধর্ম। কেননা, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই না মানতে শক্তির দরকার করে ; সেই শক্তির অহংকার তরুণের পক্ষে স্বাভাবিক। এই অহংকারের আবেগে তারা ভুল করেও থাকে সেই ভুলের বিপদ সত্ত্বেও তরুণের এই স্পর্ধাকে আমি শ্রদ্ধাই করি । কিন্তু, যেখানে না মানাই হচ্ছে সহজ পন্থা, সেখানে সেই অশক্তের সন্তা অহংকার তরুণের পক্ষেই সব চেয়ে অযোগ্য । ভাষাকে মানি নে যদি বলতে পারি তা হলে কবিতা লেখা সহজ হয়, দৈহিক সহজ উত্তেজনাকে কাব্যের মুখ্য বিষয় করতে যদি না বাধে তা হলে সামান্য খরচাতেই উপস্থিতমত কার্জ চালানো যায়, কিন্তু এইটেই সাহিত্যিক কাপুরুষতা । প্লানসিউজ জাহাজ ২৩ অগস্ট, ১৯২৭