পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৭৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

হিত্যের পথে 8Q為 সাহিত্যবিচার সাহিত্যের বিষয়টি ব্যক্তিগত। শ্রেণীগত নয়। এখানে “ব্যক্তি’ শব্দটাতে তার ধাতুমুলক অর্থের উপরেই জোর দিতে চাই ; স্বকীয় বিশেষত্বের মধ্যে যা ব্যক্ত হয়ে উঠছে, তাই ব্যক্তি । সেই ব্যক্তি স্বতন্ত্র । বিশ্বজগতে তার সম্পূর্ণ অনুরূপ আর দ্বিতীয় নেই। ব্যক্তিরূপের এই ব্যক্তিতা সকলের সমান নয়, কেউ বা সুস্পষ্ট, কেউ বা অস্পষ্ট। অন্তত, যে-মানুষ উপলব্ধি করে তার পক্ষে । সাহিত্যের ব্যক্তি কেবল মানুষ নয় ; বিশ্বের যে-কোনো পদার্থই সাহিত্যে সুস্পষ্ট তাই ব্যক্তি, জীবজন্তু, গাছপালা, নদী, পর্বত, সমুদ্র, ভালো জিনিস, মন্দ জিনিস, বস্তুর জিনিস, ভাবের জিনিস, সমস্তই ব্যক্তি- নিজের ঐকান্তিকতায় সে যদি ব্যক্ত না হল তা হলে সাহিত্যে সে লজিত । যে গুণে এরা সাহিত্যে সেই পরিমাণে ব্যক্তি হয়ে ওঠে, যাতে আমাদের চিত্ত তাকে স্বীকার করতে বাধ্য হয়, সেই গুণটি দুর্লভ- সেই গুণটিই সাহিত্যরচয়িতার । তা রজোগুণও নয়, তমোগুণও নয়, তা কল্পনাশক্তির ও রচনাশক্তির গুণ । পৃথিবীতে অসংখ্য মানুষকে, অসংখ্য জিনিসকে আমরা পুরোপুরি দেখতে পাই নে। প্রয়োজন হিসাবে বা সাংসারিক প্রভাব হিসারে তারা পুলিস ইনস্পেক্টর বা ডিট্ৰিক্ট ম্যাজিষ্ট্রেটের মতোই অত্যন্ত পরিদৃষ্ট এবং পরিপষ্ট হতে পারে, কিন্তু ব্যক্তি হিসাবে তারা হাজার হাজার পুলিস ইনস্পেক্টর এবং ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের মতোই অকিঞ্চিৎকর, এমন-কি, যাদের প্রতি তারা কর্তৃত্ব করে তাদের অনেকের চেয়ে । সুতরাং তারা অচিরকালীন বর্তমান অবস্থার বাইরে মানুষের অন্তরঙ্গরাপে প্ৰকাশমান নয় । কিন্তু, সাহিত্যরচয়িতা আপন সৃষ্টিশক্তির গুণে তাদেরও চিরকালীন রূপে ব্যক্ত করে দাড় করাতে পারে । তখন তারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দণ্ডবিধাতারূপে কোনো শ্রেণী বা পদের প্রতিনিধিরূপে নয়, কেবলমাত্র আপনি স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বের মূল্যেমূল্যবান । ধনী বলে নয়, মানী বলে নয়, জ্ঞানী বলে নয়, সৎ বলে নয়, সত্ত্ব রজ বা তমোগুণান্বিত বলে নয়, তারা স্পষ্ট ব্যক্ত হতে পেরেছে বলেই সমাদৃত । এই ব্যক্ত রূপের সাহিত্যমূল্যটি নির্ণয় ও ব্যাখ্যা করা সহজ নয় । এইজন্যেই সাহিত্যবিচারে অনেকেই ব্যক্তিপরিচয়ের দুরূহ কর্তব্যে ফাকি দিয়ে শ্রেণীর পরিচয় দিয়ে থাকেন । এই সহজ পন্থাকে সাধারণত আমাদের দেশের পাঠকেরা অশ্রদ্ধা করেন না ; বোধ করি তার প্রধান কারণ, আমাদের দেশ জাত-মানার দেশ । মানুষের পরিচয়ের চেয়ে জাতের পরিচয়ে আমাদের চোখ পড়ে বেশি । আমরা বড়োলোক বলি যার বড়ো পদ, বড়োমানুষ বলি যার অনেক টাকা । আমরা জাতের চাপ, শ্রেণীর চাপ দীর্ঘকাল ধরে পিঠের উপর সহ্য করেছি ; ব্যক্তিগত মানুষ পঙক্তিপূজক সমাজের তাড়নায় আমাদের দেশে চিরদিন সংকুচিত । বাধা রীতির বন্ধন আমাদের দেশে সর্বত্রই। এই কারণেই যে সাধু-সাহিত্য আমাদের দেশে একদা প্ৰচলিত ছিল তাতে ব্যক্তির বর্ণনা ছিল শিষ্টসাহিত্যপ্ৰথাসম্মত, শ্রেণীগত । তখন ছিল কমুদকহলারশোভিত সরোবর ; যুথীজাতি৷মল্লিকামালতীবিকশিত বসন্তঋতু ; তখনকার সকল সুন্দরীরই গমন গজেন্দ্রগমন, তাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিশ্ব দাডিম্ব সুমেরুর বাধা ছাদে । শ্রেণীর কুহেলিকার মধ্যে ব্যক্তি অদৃশ্য । সেই ঝাপসা দৃষ্টির মনোবৃত্তি আমাদের চলে গেছে তা বলতে পারি নে। এই ঝাপসা দৃষ্টিই সাহিত্য-রচনায় ও অনুভূতিতে সকলের চেয়ে বড়ো শত্ৰু । কেননা সাহিত্যে রসরাপের সৃষ্টি । সৃষ্টি মাত্রের আসল কথাই হচ্ছে প্ৰকাশ । সেইজন্যেই দেখি, আমাদের দেশের সাহিত্যবিচারে ব্যক্তির পরিচয় বাদ দিয়ে শ্রেণীর পরিচয়ের দিকেই ক্টোক দেওয়া হয় । সাহিত্যে ভালো-লাগা মন্দ-লগা হল শেষ কথা । বিজ্ঞানে সত্যমিথ্যার বিচারই শেষ বিচার । এই কারণে বিচারকের ব্যক্তিগত সংস্কারের উপরে বৈজ্ঞানিকের চরম আপিল আছে প্রমাণে । কিন্তু, ভালো মন্দ লাগাটা রুচি নিয়ে ; এর উপরে আর-কোনো আপিল অযোগ্যতম লোকও অস্বীকার করতে S S['SO