পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৮৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 VeV রবীন্দ্র-রচনাবলী এই আধুনিক পয়সাটার দাম কম কিন্তু জোর বেশি, আর এ খুব স্পষ্ট, টং করে বেজে ওঠে হালের সুরে । সাবেক-কালের যে-মাধুরী তার একটা নেশা আছে, কিন্তু এর আছে স্পর্ধা। এর মধ্যে ঝাপসা কিছুই নেই। এখনকার কাব্যের যা বিষয় তা লালিত্যে মন ভোলাতে চায় না । তা হলে সে কিসের জোরে দাঁড়ায় । তার জোর হচ্ছে আপনি সুনিশ্চিত আত্মতা নিয়ে, ইংরেজিতে যাকে বলে ক্যারেক্টর । সে বলে, “অয়মহং ভোঃ, আমাকে দেখো ।” ঐ মেয়ে কবি, তার নাম এমি লোয়েল, একটি কবিতা লিখেছেন লাল চটিজুতোর দোকান নিয়ে। ব্যাপারখানা। এই যে, সন্ধ্যাবেলায় বাইরে বরফের ঝাপটা উড়িয়ে হাওয়া বইছে, ভিতরে পালিশ-করা কাচের পিছনে লম্বা সার করে ঝুলছে লাল চটিজুতোর Nil- like stalactites of blood, flooding the eyes of passers-by with dripping color, jamming their crimson reflections against the windows of cabs and tramcars, screaming their claret and salmon into the teeth of the sleet, plopping their little round maroon lights upon the tops of umbrellas. The row of white, sparkling shop fronts is gashed and bleeding, it bleeds red slippers সমস্তটা এই চটিজুতো নিয়ে । একেই বলা যায় নৈর্ব্যক্তিক, impersonal । ঐ চটিজুতোর মালার উপর বিশেষ আসক্তির কোনো কারণ নেই, না খরিদদার না দোকানদার ভাবে । কিন্তু, দাড়িয়ে দেখতে হল, সমস্ত ছবির একটা আত্মতা যেই ফুটে উঠল অমনি তার তুচ্ছতা আর রইল না। যারা মানে-কুড়ানিয়া তারা জিজ্ঞাসা করবে, “মানে কী হল, মশায় । চটিজুতো নিয়ে এত হাল্লা কিসের, নাহয় হলেই বা তার রঙ লাল ।” উত্তরে বলতে হয়, “চেয়েই দেখো-না৷ ” “দেখে লাভ কী’ তার কোনো জবাব নাই । নন্দনতত্ত্ব (Aesthetics) সম্বন্ধে এজরা পৌন্ডের একটি কবিতা আছে। বিষয়টি এই যে, একটি মেয়ে চলেছিল রাস্তা দিয়ে, একটা ছোটো ছেলে, তালি দেওয়া কাপড় পরা, তার মন উঠল। জেগে, সে থাকতে পারল না ; বলে উঠল, “দেখ চেয়ে রে, কী সুন্দর।” এই ঘটনার তিন বৎসর পরে ঐ ছেলেটারই সঙ্গে আবার দেখা । সে বছর জালে সার্ডিন মাছ পড়েছিল বিস্তর । বড়ো বড়ো কাঠের বাক্সে ওর দাদা খুড়োরা মাছ সাজাচ্ছিল, ব্রেসচিয়ার হাটে বিক্রি করতে পাঠাবে । ছেলেটা মাছ ঘাটাঘাটি করে লাফালাফি করতে লাগল। বুড়োরা ধমক দিয়ে বললে, “স্থির হয়ে বোস।” তখন সে সেই সাজানো মাছগুলোর উপর হাত বুলোতে বুলোতে তৃপ্তির সঙ্গে ঠিক সেই একই কথা আপন মনে বলে উঠল, “কী সুন্দর।” কবি বলছেন, “শুনে। I was mildly abashed ' সুন্দরী মেয়েকেও দেখো, সার্ডিন মাছকেও ; একই ভাষায় বলতে কুষ্ঠিত হােয়ো না, কী সুন্দর। এ দেখা নৈর্ব্যক্তিক— নিছক দেখা- এর পঙক্তিতে চটিজুতোর দোকানকেও বাদ দেওয়া যায় না । কাব্যে বিষয়ীর আত্মতা ছিল। উনিশ শতাব্দীতে, বিশ শতাব্দীতে বিষয়ের আত্মতা । এইজন্যে কাব্যবস্তুর বাস্তবতার উপরেই ঝোক দেওয়া হয়, অলংকারের উপর নয়। কেননা, অলংকারটা ব্যক্তির নিজেরই রুচিকে প্ৰকাশ করে, খাটি বাস্তবতার জোর হচ্ছে বিষয়ের নিজের প্রকাশের জন্যে । সাহিত্যে আবির্ভাবের পূর্বেই এই আধুনিকতা ছবিতে ভর করেছিল। চিত্ৰকলা যে ললিতকলার অঙ্গ, এই কথাটাকে অস্বীকার করবার জন্যে সে বিবিধাপ্রকারে উৎপাত শুরু করে দিলে । সে বললে, আর্টের কাজ মনোহারিতা নয়, মনোজায়িতা ; তার লক্ষণ লালিত্য নয়, যাথার্থ । চেহারার মধ্যে মোহকে মানলে না, মানলে ক্যারেক্টারকে অর্থাৎ একটন সমগ্রতার আত্মঘোষণাকে । নিজের সম্বন্ধে সেই চেহারা আর-কিছু পরিচয় দিতে চায় না, কেবল জোরের সঙ্গে বলতে চায় “আমি দ্রষ্টব্য । তার দ্বারা । এই সত্য ধৰ্মনৈতিক নয়, ব্যবহারনৈতিক নয়, ভাবব্যঞ্জক নয়, এ সত্য সৃষ্টিগত । অর্থাৎ, সে হয়ে উঠেছে বলেই তাকে স্বীকার করতে হয়। যেমন আমরা ময়ূরকে মেনে নেই, শকুনিকেও মানি, শুয়োরকে অস্বীকার করতে পারি নে, হরিণকেও তাই ।