পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৮৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8१० রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী অবশেষে শরতের প্রথম হাওয়ায় তার উপরে জমে উঠল ঝরা পাতা । এখন অষ্টম মাস, হলদে প্ৰজাপতিগুলো আমাদের পশ্চিম-বাগানের ঘাসের উপর ঘুরে ঘুরে বেড়ায় । আমার বুক যে ফেটে যাচ্ছে, ভয় হয় পাছে আমার রূপ যায় স্নান হয়ে । ওগো, যখন তিনটে জেলা পার হয়ে তুমি ফিরবে আগে থাকতে আমাকে খবর পাঠাতে ভুলো না । চাঙফেণ্ডশার দীর্ঘ পথ বেয়ে আমি আসব, তোমার সঙ্গে দেখা হবে । দূর বলে একটুও ভয় করব না । এই কবিতায় সেন্টিমেন্টের সুর একটুও চড়ানাে হয় নি, তেমনি তার পরে বিদ্রুপ বা অবিশ্বাসের কটাক্ষপাত দেখছি নে । বিষয়টা অত্যন্ত প্রচলিত, তবু এতে রসের অভাব নেই। স্টাইল বেঁকিয়ে দিয়ে একে ব্যঙ্গ করলে জিনিসটা আধুনিক হত । কেননা, সবাই যাকে অনায়াসে মেনে নেয়। আধুনিকেরা কাব্যে তাকে মানতে অবজ্ঞা করে। খুব সম্ভব, আধুনিক কবি ঐ কবিতার উপসংহারে লিখত, স্বামী চোখের জল মুছে পিছন ফিরে তাকাতে তাকাতে চলে গেল, আর মেয়েটি তখনি লাগল শুকনো চিংড়িমাছের বাড়া ভাজতে । কার জন্যে । এই প্রশ্নের উত্তরে থাকত দেড় লাইন ভরে ফুটুকি । সেকেলে পাঠক জিজ্ঞাসা করত, “এটা কী হল ।” একেলে কবি উত্তর করত, “এমনতরো হয়েই থাকে ৷” ‘অন্যটাও তো হয়।” “হয় বটে, কিন্তু বড়ো বেশি ভদ্র । কিছু দুৰ্গন্ধ না থাকলে ওর শৌখিন ভােব ঘোচে না, আধুনিক হয় না।” সেকালে কাব্যের বাবুগিরি ছিল, সৌজন্যের সঙ্গে জড়িত । একেলে কাব্যেরও বাবুগিরি আছে, সেটা পচা মাংসের বিলাসে । চীনে কবিতাটির পাশে বিলিতি কবিদের আধুনিকতা সহজ ঠেকে না। সে আবিল। তাদের মনটা পাঠককে কনুই দিয়ে ঠেলা মারে । তারা যো-বিশ্বকে দেখছে এবং দেখাচ্ছে সেটা ভাঙন-ধরা, রাবিশ-জমা, ধুলো-ওড়া। ওদের চিত্ত যে আজ অসুস্থ, অসুখী, অব্যবস্থিত । এ অবস্থায় বিশ্ববিষয় থেকে ওরা বিশুদ্ধভাবে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে পারে নয় । ভাঙা প্ৰতিমার কাঠ খড় দেখে ওরা অট্টহাস্য করে ; বলে, আসল জিনিসটা এতদিনে ধরা পড়েছে। সেই ঢেলা, সেই কাঠখড়গুলোকে খোচা মেরে কড়া কথা বলাকেই ওরা বলে খাটি সত্যকে জোরের সঙ্গে স্বীকার করা । এই প্রসঙ্গে এলিয়টের একটি কবিতা মনে পড়ছে। বিষয়টি এই : বুড়ি মারা গেল, সে বড়ো ঘরের মহিলা । যথানিয়মে ঘরের ঝিলিমিলিগুলো নাবিয়ে দেওয়া, শববাহকেরা এসে দস্তুরমত সময়োচিত ব্যবস্থা করতে প্ৰবৃত্ত । এ দিকে খাবার ঘরে বাড়ির বড়ো-খানসামা ডিনার-টেবিলের ধারে বসে, বাড়ির মেজো-বিকে কোলের উপর টেনে নিয়ে । ঘটনাটা বিশ্বাসযোগ্য এবং স্বাভাবিক সন্দেহ নাই । কিন্তু, সেকেলে মেজাজের লোকের মনে প্রশ্ন উঠবে, তা হলেই কি যথেষ্ট হল । এ কবিতাটা, লেখবার গরজ কী নিয়ে, এটা পড়তেই বা যাব কেন । একটি মেয়ের সুন্দর হাসির খবর কোনো কবির লেখায় যদি পাই তা হলে বলব, এ খবরটা দেবার মতো বটে। কিন্তু, তার পরেই যদি বর্ণনায় দেখি, ডেন্টিসট এল, সে তার যন্ত্র নিয়ে পরীক্ষা করে দেখলে মেয়েটির দাতে পোকা পড়েছে, তা হলে বলতে হবে, নিশ্চয়ই এটাও খবর বটে কিন্তু সবাইকে ডেকে ডেকে বলবার মতো খবর নয়। যদি দেখি কারও এই কথাটা প্রচার করতেই বিশেষ ঔৎসুক্য, তা হলে সন্দেহ করব, তারও মেজাজে পোকা পড়েছে। যদি বলা হয়, আগেকার কবিরা বাছাই ক’রে কবিতা লিখতেন, অতি-আধুনিকরা বাছাই করেন না, সে কথা মানতে পারি। নে ; ঐরাও বাছাই করেন । তাজা ফুল বাছাই করাও বাছাই, আর শুকনো পোকায়-খাওয়া ফুল বাছাইও বাছাই । কেবল তফাত এই যে, ঐরা সর্বদাই ভয় করেন পাছে ঐদের কেউ বদনাম দেয় যে ঐদের বাছাই করার শখ আছে । অঘোরপন্থীরা বেছে বেছে কুৎসিত জিনিস খায়, দূষিত জিনিস ব্যবহার করে, পাছে এটা প্রমাণ হয় - ভালো জিনিসে তাদের পক্ষপাত । তাতে ফল হয়, অ-ভালো জিনিসেই তাদের পক্ষপাত পাকা হয়ে ওঠে । কাব্যে অঘোরপাহীর সাধনা যদি প্রচলিত হয়, তা হলে শুচি জিনিসে যাদের স্বাভাবিক রুচি তারা