পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫০৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8trb রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী আমাদের মনের কাছে নিবিড়ােতর সত্য ক’রে দেখিয়ে দেন । রামায়ণ রচিত হল, রচিত হল মহাভারত । রামকে পেলুম ; সে তো একটিমাত্র মানুষের রূপ নয়, অনেক কাল থেকে অনেক মানুষের মধ্যে যে-সকল বিশেষ গুণের ক্ষণে ক্ষণে কিছু কিছু স্বাদ পাওয়া গেছে কবির মনে সে-সমস্তই দানা বেঁধে উঠল রামচন্দ্রের মূর্তিতে । রামচন্দ্র হয়ে উঠলেন আমাদের মনের মানুষ । বাস্তব সংসারে অনেক বিক্ষিপ্ত ভালো লোকের চেয়ে রামচন্দ্ৰ আমাদের মনের কাছে সত্যমানুষ হয়ে ওঠেন । মন তাকে যেমন করে স্বীকার করে প্রত্যক্ষ হাজার হাজার লোককে তেমন ক’রে স্বীকার করে না । মনের মানুষ বলতে যে বুঝতে হবে আদর্শ ভালো লোক তা নয়। সংসারে মন্দ লোকও আছে ছড়িয়ে, নানা-কিছুর সঙ্গে মিশিয়ে ; আমাদের পাচ-মিশোলি অভিজ্ঞতার মধ্যে তাদের মন্দত্ব অসংলগ্ন হয়েই দেখা দেয় । সেই বহু লোকের বহুবিধ মন্দত্বের খণ্ড খণ্ড পরিচয় সংসারে আমাদের কাছে ক্ষণে ক্ষণে এসে পড়ে ; তারা আসে, তারা যায়, তারা আঘাত করে, নানা ঘটনায় চাপা পড়ে তারা অগোচর হতে থাকে । সাহিত্যে তারা সংহত আকারে ঐক্য লাভ করে আমাদের নিত্যমনের সামগ্ৰী হয়ে ওঠে ; তখন তাদের আর ভুলতে পারি নে। শেকসপীয়রের রচিত ফলসটাফ একটি বিশিষ্ট মানুষ সন্দেহ নেই। তবু বলতে হবে, আমাদের অভিজ্ঞতায় অনেক মানুষের কিছু কিছু আভাস আছে, শেকসপীিয়রের প্রতিভার গুণে তাদের সমবায় ঘনীভূত হয়েছে। ফলস্টাফ চরিত্রে । জোড়া লাগিয়ে তৈরি নয়, কল্পনার রসে জারিত ক'রে তার সৃষ্টি ; তার সঙ্গে আমাদের মনের মিল খুব সহজ, এইজন্যে তাতে আমাদের আনন্দ । এমন কথা মনে হতে পারে, সাবেক-কালের কাব্য-নাটকে আমরা যাদের দেখতে পাই তারা এক-একটা টাইপ, তারা শ্রেণীগত ; তাই তারা একই-জাতীয় অনেকগুলি মানুষের ভাঙাচোরা উপকরণ নিয়ে তৈরি । কিন্তু, আধুনিক কালে সাহিত্যে আমরা যে-চরিত্র দেখি তা ব্যক্তিগত । প্রথম কথা এই যে, ব্যক্তিগত মানুষেরও শ্রেণীগত ভিত্তি আছে, একান্ত শ্রেণীবিচ্ছিন্ন মানুষ নেই। প্ৰত্যেক মানুষের মধ্যেই আছে বহু মানুষ, আর সেইসঙ্গেই জড়িত হয়ে আছে সেই এক মানুষ যে বিশেষ। চরিত্রসৃষ্টিতে শ্রেণীকে লঘু ক'রে ব্যক্তিকেই যদি-বা প্রাধান্য দিই। তবু সেই ব্যক্তিকে আমাদের ধারণার সম্পূর্ণ অধিগম্য করতে হলে তাতে আটিস্টের হাত পড়া চাই। এই আর্টিস্টের সৃষ্টি প্রকৃতির সৃষ্টির ধারা অনুসরণ করে না । এই সৃষ্টিতে যে-মানুষকে দেখি, প্রকৃতির হাতে যদি সে তৈরি হত তা হলে তার মধ্যে অনেক বাহুল্য থাকত ; সে বাস্তব যদি হত। তবু সত্য হত না, অর্থাৎ আমাদের হৃদয় তাকে নিঃসংশয় প্রামাণিক বলে মানত না । তার মধ্যে অনেক ফাক থাকত, অনেক-কিছু থাকত যা নিরর্থক,আগে-পিছের ওজন ঠিক থাকত না। তার ঐক্য আমাদের কাছে সুস্পষ্ট হত না । শতদল পদ্মে যে-ঐক্য দেখে আমরা তাকে মুহুর্তেই বলি সুন্দর, তা সহজ- তার সংকীর্ণ বৈচিত্র্যের মধ্যে কোথাও পরম্পর দ্বন্দ্ব নেই, এমন-কিছু নেই যা অযথা ; আমাদের হৃদয় তাকে অধিকার করতে পারে অনায়াসে, কোথাও বাধা পায় না । মানুষের সংসারে দ্বন্দ্ববহুল বৈচিত্র্যে আমাদের উদভ্ৰান্ত করে দেয় । যদি তার কোনো একটি প্রকাশকে স্পষ্টরূপে হৃদয়গম্য করতে হয় তা হলে আটিস্টের সুনিপুণ কল্পনা চাই । অর্থাৎ, বাস্তবে যা আছে বাইরে তাকে পরিণত করে তুলতে হবে মনের জিনিস করে । আটিস্টের সামনে উপকরণ আছে বিস্তরী- সেগুলির মধ্যে গ্রহণ বর্জন করতে হবে কল্পনার নির্দেশমত । তার কোনোটাকে বাড়াতে হবে, কোনোটাকে কমাতে ; কোনোটাকে সামনে রাখতে হবে, কোনোটাকে পিছনে। বাস্তবে যা বাহুল্যের মধ্যে বিক্ষিপ্ত তাকে এমন করে সংহত করতে হবে যাতে আমাদের মন তাকে সহজে গ্রহণ করে তার সঙ্গে যুক্ত হতে পারে। প্রকৃতির সৃষ্টির দূরত্ব থেকে মানুষের ভাষায় সুখেৰে তাকে মর্মািম নৈকট্য দিতে হবে , সেই নৈকটা খটায় বলেই সাহিতাকে আমরা সাহিত্য r মানুষ যে-বিশ্বে জন্মেছে, তাকে দুই দিক থেকে কেবলই আত্মসাৎ করবার চেষ্টা করছে, ব্যবহারের দিক থেকে আর ভাবের দিক থেকে । আগুন যেখানে প্রচ্ছন্ন সেখানে মানুষ জ্বালল আগুন নিজের হাতে ; আকাশের আলো যেখানে অগোচর। সেখানে সে বৈদ্যুতিক আলোককে প্রকাশ করলে নিজের কৌশলে ; প্রকৃতি আপনি যে ফলমূল ফসল বরাদ্দ করে দিয়েছে তার অনিশ্চয়তা ও অসচ্ছলতা সে