পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫০৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8to রবীন্দ্র-রচনাবলী জাগিায়ৈ তোলে ; বিধাতার হাতের পাসপোর্ট নেই। যার কাছে তাকে সে উত্তীৰ্ণ ক’রে দেয় মনােলোকে । অনেক সময় বড়ো আর্টিস্ট অবজ্ঞা করে সহজ মনোহরকে আপনি সৃষ্টিতে ব্যবহার করতে । মানুষ বস্তুজগতের উপর আপনি বুদ্ধিকৌশল বিস্তার ক’রে নিজের জীবনযাত্রার একান্ত অনুগত একটি ব্যাবহারিক জগৎ সর্বদাই তৈরি করতে লেগেছে। তেমনি মানুষ আপন ইন্দ্ৰিয়বোধের জগৎকে পরিব্যাপ্ত ক'রে বিচিত্র কলাকৌশলে আপন ভাবরিসভোগের জগৎ সৃষ্টি করতে প্ৰবৃত্ত । সেই তার সাহিত্য । ব্যাবহারিক বুদ্ধিনৈপুণ্যে মানুষ কলে বলে কৌশলে বিশ্বকে আপন হাতে পায়, আর কলানৈপুণ্যে কল্পনাশক্তিতে বিশ্বকে সে আপনি কাছে পায় । প্রয়োজনসাধনে এর মূল্য নয় ; এর মূল্য আত্মীয়তাসাধনে, সাহিত্যসাধনে । একবার সেকালের দিকে তাকিয়ে দেখা যাক । সাহিত্যসাধনা সম্বন্ধে তখনকার দিনের মনোভাবের পরিচয় আছে একটি কাহিনীতে ; সেটা আলোচনার যোগ্য । ক্ৰৌঞ্চমিথুনের মধ্যে একটিকে ব্যাধ যখন হত্যা করলে তখন ঘূণার আবেগে কবির কণ্ঠ থেকে অনুটুভ ছন্দ সহসা উচ্চারিত হল । কল্পনা করা যাক, বিশ্বসৃষ্টির পূর্বে সৃষ্টিকর্তার ধ্যানে সহসা জ্যোতি উঠল। জেগে । এই জ্যোতির আছে অফুরান বেগ, আছে প্ৰকাশশক্তি। স্বতই প্রশ্ন উঠল, অনন্তের মধ্যে এই জ্যোতি নিয়ে কী করা যাবে। তারই উত্তরে জ্যোতিরাত্মক অণুপরমাণুর সংঘ নিত্য-অভিব্যক্ত বিচিত্র রূপ ধরে আকাশে আকাশে আবর্তিত হয়ে চলল- এই বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডের মহিমা সেই আদিজ্যোতিরই উপযুক্ত । কবিঝষির মনে যখন সহসা সেই বেগবান শক্তিমান ছন্দের আবির্ভাব হল তখন স্বতই প্রশ্ন জাগল, এরই উপযুক্ত সৃষ্টি হওয়া চাই। তারই উত্তরে রচিত হল রামচরিত। অর্থাৎ, এমন-কিছু যা নিত্যতার আসনে প্রতিষ্ঠিত হবার যোগ্য । যার সান্নিধ্য অর্থাৎ যার সাহিত্য মানুষের কাছে আদরণীয় । মানুষের নির্মাণশক্তি বলশালী, আশ্চর্য তার নৈপুণ্য । এই শক্তি নিয়ে, এই নৈপুণ্য নিয়ে, সে বড়ো বড়ো নগর নির্মাণ করেছে। এই নগরের মূর্তি যেন মানুষের গৌরব করবার যোগ্য হয়, এ কথা সেই জাতির মানুষ না ইচ্ছা করে থাকতে পারে নি যাদের শক্তি আছে, যাদের আত্মসম্মানবোধ আছে, যারা সভ্য। সাধারণত সেই ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও নানা রিপু এসে ব্যাঘাত ঘটায়- মুনাফা করবার লোভ আছে, সন্তায় কাজ সারবার কৃপণতা আছে, দরিদ্রের প্রতি ধনী কর্তৃপক্ষের ঔদাসীন্য আছে, অশিক্ষিত বিকৃতরুচি বর্বরতাও এসে পড়ে এর মধ্যে ; তাই নির্লজ নির্মমতায় কুৎসিত পাটকল উঠে দাড়ায় গঙ্গাতীরের পবিত্র শ্যামলতাকে পদদলিত করে, তাই প্রাসাদশ্রেণীর অন্তরালে নানাজাতীয় দূরদৃশ্য বক্তিপাড়া অস্বাস্থ্য ও অশোভনতাকে পালন করতে থাকে আপনি কলুষিত আশ্রয়ে, যেমন-তেমন কদৰ্যভাবে যেখানে-সেখানে ঘরবাড়ি তেলকল নোংরা দোকান গলিখুঁজি চোখের ও মনের পীড়া বিস্তারপূর্বক দেশে ও কালে আপনি স্বত্বাধিকার পাকা করতে থাকে। কিন্তু, রিপুর প্রবলতা ও অক্ষমতার নিদর্শনস্বরূপে এই সমস্ত ব্যত্যয়কে স্বীকার করে। তবুও মোটের উপরে এ কথা মানতে হবে যে, সমস্ত শহরটা শহরবাসীর গৌরব করবার উপযুক্ত যাতে হয় এই ইচ্ছাটাই সত্য। কেউ বলবে না, শহরের সত্য তার কদৰ্য বিকৃতিগুলো । কেননা, শহরের সঙ্গে শহরবাসীর অত্যন্ত নিকটের যোগ ; সে যোগ স্থায়ী যোগ, সে যোগ আীয়তার যোগ, এমন যোগ নয় যাতে তার আত্মাবমাননা । সাহিত্য সম্বন্ধেও ঠিক এই কথাই বলা চলে। তার মধ্যে রিপুর আক্রমণ এসে পড়ে, ভিতরে ভিতরে দুর্বলতার নানা চিহ্ন দেখা দিতে থাকে, মলিনতার কলঙ্ক লাগতে থাকে যেখানে-সেখানে ; কিন্তু, তবু সকল হীনতা-দীনতাকে ছাড়িয়ে উঠে যে-সাহিত্যে সমগ্ৰ ভাবে মানুষের মহিমা প্ৰকাশ না হয় তাকে নিয়ে গৌরব করা চলবে না, কেননা সাহিত্যে মানুষ আপনারই সঙ্গকে, আপনার সাহিত্যকে প্ৰকাশ করে স্থায়িত্বের উপাদানে। কেননা চিরকালের মানুষ বাস্তব নয়, চিরকালের মানুষ ভাবুক ; চিরকালের মানুষের মনে যে-আকাঙক্ষা প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে কাজ করেছে তা অভ্ৰভেদী, তা স্বৰ্গাভিমুখী, তা অপরাহত পৌরুষের তেজে জ্যোতির্ময় । সাহিত্যে সেই পরিচয়ের ক্ষীণতা যদি কোনো ইতিহাসে দেখা যায় তা হলো লজ্জা পেতে হবে ; কেননা সাহিত্যে মানুষ নিজেরই অন্তরতম পরিচয় দেয় নিজের অগোচরে, যেমন পরিচয় দেয়। ফুল তার গন্ধে, নক্ষত্র তার আলোকে । এই পরিচয় সমস্ত