পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫১৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সাহিত্যের পথে 8为气 তাই বাঙালিকে সেদিন সকলে গ্ৰাম্য বলে জেনেছিল । তাই ধারা সংস্কৃতভাষার চর্চা করেছিলেন এবং সংস্কৃতশাস্ত্রের মধ্য দিয়ে বিশ্বাসত্যের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন তঁরা বঙ্গভাষায় একান্ত-আবদ্ধ চিত্তের সম্মান করতে পারেন নি । বাংলার পাচলিসাহিত্য ও পয়ারের কথা তাদের কাছে নগণ্য ছিল । অনাদরের ফল কী হয় । অনাদৃত মানুষ নিজেকে অনাদরণীয় বলে বিশ্বাস করে ; মনে করে, স্বভাবতই সে জ্যোতিহীন । কিন্তু, এ কথাটা তো গভীর ভাবে সত্য নয় ; আত্মপ্রকাশের অভাবেই তার আত্মবিস্মৃতি । যখন সে আপনাকে প্রকাশ করবার উপযুক্ত উপলক্ষ পায় তখন সে আর আপনার কাছে আপনি প্রচ্ছন্ন থাকে না । উপযুক্ত আধারটি না পেলে প্ৰদীপ আপনার শিখা সম্বন্ধে আপনি অন্ধ থাকে। অতএব, যেহেতু মানুষের আত্মপ্রকাশের প্রধান বাহন হচ্ছে তার ভাষা তাই তার সকলের চেয়ে বড়ো কাজ-ভাষার দৈন্য দূর করে আপনার যথার্থ পরিচয় লাভ করা এবং সেই পূর্ণ পরিচয়টি বিশ্বের সমক্ষে উদঘাটিত করা । আমার মনে পড়ে, আমাদের বাল্যকালে বাংলাদেশে একদিন ভাবের তাপস বঙ্কিমচন্দ্ৰ কোন এক উদবোধনমন্ত্র উচ্চারণ করেছিলেন, তাতে হঠাৎ যেন বহু দিনের কৃষ্ণপক্ষ তার কালো পৃষ্ঠা উলটিয়ে দিয়ে শুক্লপক্ষীরূপে আবির্ভূত হল। তখন যে-সম্পদ আমাদের কাছে উদঘাটিত হয়েছিল শুধু তার জন্যেই যে আমাদের আনন্দ ছিল তা নয়। কিন্তু, হঠাৎ সম্মুখে দেখা গেল, একটি অপরিসীম। আশার ক্ষেত্র বিস্তারিত । কী যে হবে, কত যে পাব, ভাবীকাল যে কোন অভাবনীয়কে বহন করে আনবে, সেই ঔৎসুক্যে মন ভরে উঠল । এই-যে মনে অনুভূতি জাগে যে, সৌভাগ্যের বুঝি কোথাও শেষ নেই, এই-যে হৃৎস্পন্দনের মধ্যে আগন্তুক অসীমের পদাশঙ্গ শুনতে পাওয়া যায়, এতেই সৃষ্টিকাৰ্য অগ্রসর হয়। সকল বিভাগেই এই ব্যাপারটি ঘটে থাকে । রাষ্ট্ৰীয় ক্ষেত্রে একদিন বাঙালির এবং ভারতবাসীর আশা সংকীর্ণ সীমায় বন্ধ ছিল । তাই কংগ্রেস মনে করেছিল যে, যতটুকু ইংরাজ হাতে তুলে দেবে সেই প্ৰসাদটুকু লাভ করেই বড়ো হওয়া যাবে। কিন্তু, এই সীমাবদ্ধ আশা যেদিন ঘুচে গেল সেদিন মনে হল যে, আমার আপনার মধ্যে যে-শক্তি আছে তার দ্বারাই দেশের সকল সম্পদকে আহবান করে আনতে পারব । এইরূপ অসীম আশার দ্বারাই অসাধ্য সাধন হয় । আশাকে নিগড়িবদ্ধ করলে কোনো বড়ো কাজ হয় না । বাঙালি কোথায় এই অসীমতার পরিচয় পেয়েছে। সেখানেই যেখানে নিজের জগৎকে নিজে সৃষ্টি করে তার মধ্যে বিরাজ করতে পেরেছে। মানুষ নিজের জগতে বিহার করতে না পারলে, পরান্নভোজী পরাবসথশায়ী হলে তার আর দুঃখের অন্ত থাকে না । তাই তো কথা আছে, স্বধর্মে নিধনং শ্ৰেয়ঃ পরধর্মে ভয়াবহঃ । আমার যা ধর্ম তাই আমার সৃষ্টির মূলশক্তি, আমিই স্বয়ং আমার আশ্রয়স্থল তৈরি করে তার মধ্যে বিরাজ করব। প্রত্যেক জাতির স্বকীয় সৃষ্টি তার স্বকীয় প্রকৃতি অনুসারে বিচিত্র আকার ধারণ করে থাকে । সে রাষ্ট্র, সমাজ, সাহিত্য, শিল্পকলা প্রভৃতি নানা ক্ষেত্রে আপনি জগৎকে বিশেষভাবে রচনা ক’রে তাতে সঞ্চারণ করার অধিকার লাভ করে থাকে । বাঙালিজাতি তার আনন্দময় সত্তাকে প্রকাশ করবার একমাত্র ক্ষেত্র লাভ করেছে বাংলাভাষার মধ্যে । সেই ভাষাতে একদা এমন এক শক্তির সঞ্চার হয়েছিল যাতে করে সে নানা রচনারীপের মধ্যে যেন অসন্থত হয়ে উঠেছিল ; বীজ যেমন আপন প্রাণশক্তির উদবোলতায় নিজের আবরণ বিদীর্ণ করে অঙ্কুরকে উদ্ভিন্ন করে তেমনি আর কি । যদি তার এই শক্তি নিতান্ত ক্ষীণ হত। তবে তার সাহিত্য ভালো করে আত্মসমর্থন করতে পারত না। বিদেশ থেকে বন্যার স্রোতের মতো আগত ভাবধারা তাকে ধুয়ে মুছে দিত। - এমন বিলুপ্তির পরিচয় আমরা অন্যত্র পেয়েছি। ভারতবর্ষের অন্য অনেক জায়গায় ইংরাজি-চৰ্চা খুব প্রবল। সেখানে ইংরাজিভাষায় স্বজাতীয়ের মধ্যে, পরমায়ীয়ের মধ্যে পত্রব্যবহার হয়ে থাকে । এমন দৈন্যদশা যে, পিতাপুত্রের পরস্পরের মধ্যে শুধু ভাবের নয় সামান্য সংবাদের আদান-প্ৰদানও বিদেশী ভাষার সহায়তায় ঘটে । রাষ্ট্ৰীয় অধিকার লাভের আগ্ৰহ প্ৰকাশ করে যে-মুখে বলে বন্দেমাতরম সেই মুখেই মাতৃদত্ত পরম অধিকার যে মাতৃভাষা তার অসম্মান করতে মনে কোনো আক্ষেপ বোধ করে না । বাংলাদেশেও যে এই আত্মাবমাননার লক্ষণ একেবারে নেই তা বলতে পারি। নে । তবে কিনা। এ