পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫১৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8sbr রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী সম্বন্ধে বাঙালির মনে একটা লজ্জার বোধ জন্মেছে । আজকের দিনে বাঙালির ডাকঘরের রাস্তায় বাংলা চিঠিরই ভিড় সব চেয়ে বেশি । বাস্তবিক মাতৃভাষার প্রতি যদি সম্মানবোধ জন্মে থাকে। তবে স্বদেশীকে আত্মীয়কে ইংরাজি লেখার মতো কুকীর্তি কেউ করতে পারে না । এক সময়ে বাংলাদেশে এমন হয়েছিল যে ইংরাজি কাব্য লিখতে লোকের আগ্রহের সীমা ছিল না । তখন ইংরাজি রচনা, ইংরাজি বক্তৃতা, অসামান্য গৌরবের বিষয় ছিল । আজকাল আবার বাংলাদেশে তারই পাল্টা ব্যাপার ঘটছে । এখন কেউ কেউ আক্ষেপ করে থাকেন যে, মাদ্রাজিরা বাঙালিদের চেয়ে ভালো ইংরাজি বলতে পারে । এই অপবাদ যেন আমরা মাথার মুকুট করে পরি। আজকে প্রবাসের এই বঙ্গসাহিত্যসম্মিলনী হঠাৎ আত্মপ্রকাশের জন্য উৎসুক হয়েছে ; এই আগ্রহের কারণ হচ্ছে, বাঙালি আপন প্ৰাণ দিয়ে একটি প্ৰাণবান সাহিত্যকে গড়ে তুলেছে। যেখানে বাংলার শুধু ভৌগোলিক অধিকার সেখানে সে মানচিত্রের সীমাপরিধিকে ছাড়াতে পারে না । সেখানে তার দেশ বিধাতার সৃষ্ট দেশ ; সম্পূর্ণ তার স্বদেশ নয়। কিন্তু, ভাষা-বসুন্ধরাকে আশ্রয় ক’রে যে মানসদেশে তার চিত্ত বিরাজ করে সেই দেশ তার ভূ-সীমানার দ্বারা বাধাগ্ৰস্ত নয়, সেই দেশ তার স্বজাতির সৃষ্ট দেশ । আজ বাঙালি সেই দেশটিকে নদী প্ৰান্তর পর্বত অতিক্রম করে সুদূরপ্রসারিতরূপে দেখতে পাচ্ছে, তাই বাংলার সীমার মধ্য থেকে বাংলার সীমার বাহির পর্যন্ত তার আনন্দ বিস্তীর্ণ হচ্ছে । খণ্ড দেশকালের বাহিরে সে আপন চিত্তের অধিকারকে উপলব্ধি করছে । ইতিহাস পড়লে জানা যায় যে, ইংলন্ডে ও স্কটল্যান্ডে এক সময়ে বিরোধের অন্ত ছিল না । এই দ্বন্দ্বের সমাধান কেমন করে হয়েছিল । শুধু কোনো একজন স্কটল্যান্ডের রাজপুত্রকে সিংহাসনে রসিয়ে তা হয় নি। আসলে যখন চ্যাসার প্রভৃতি কবিদের সময়ে ইংরাজি ভাষা সাহিত্যসম্পদশালী হয়ে উঠল তখন তার প্রভাব বিস্তৃত হয়ে স্কটলন্ডকে আকৃষ্ট করেছিল। সে-ভাষা। আপনি ঐশ্বর্যের শক্তিতে স্কটল্যান্ডের বরমাল্য অধিকার করে নিয়েছিল। এমনি করেই দুই বিরোধী জাতি ভাষার ক্ষেত্রে একত্ৰ মিলিত হল, জ্ঞানের ভাবের একই পথে সহযাত্রী হয়ে আত্মীয়তার বন্ধনকে অন্তরে স্বীকার করায় তাদের বাহিরের ভেদ দূর হল । দূরপ্রদেশবাসী বাঙালি যে বাংলাভাষাকে আঁকড়ে থাকতে চাচ্ছে, প্রবাসের ভাষাকে যে স্বীকার করে নিতে ইচ্ছে করছে না, তারও কারণ এই যে, সাহিত্যসম্পদশালী বাংলাভাষার শক্তি তার মনকে জিতে নিয়েছে। এইজন্যেই, সে যত দূরেই থাক, আপন ভাষার গৌরববোধের সূত্রে বাংলার বাঙালির সঙ্গে তার যোগ সুগভীর হয়ে রয়েছে। এই যোগকে ছেদন করতে তার ব্যথা বোধ হয়, একে উপলব্ধি করতে তার আনন্দ । বাল্যকালে এমন আলোচনাও আমি শুনেছি যে, বাঙালি যে বঙ্গভাষার চর্চায় মন দিয়েছে এতে করে ভারতীয় ঐক্যের অন্তরায় সৃষ্টি হচ্ছে। কারণ, ভাষার শক্তি বাড়তে থাকলে তার দৃঢ় বন্ধনকে শিথিল করা কঠিন হয় । তখনকার দিনে বঙ্গসাহিত্য যদি উৎকর্ষ লাভ না করত। তবে আজকে হয়তো তার প্রতি মমতা ছেড়ে দিয়ে আমরা নির্বিকার চিত্তে কোনো একটি সাধারণ ভাষা গ্ৰহণ করে বসতাম । কিন্তু, ভাষা জিনিসের জীবনধর্ম আছে । তাকে ছাচে ঢেলে কলে ফেলে ফরমাশে গড়া যায় না । তার নিয়মকে স্বীকার করে নিয়ে তবেই তার কাছ থেকে সম্পূৰ্ণ ফল পাওয়া যায়। তার বিরুদ্ধগামী হলে সে বন্ধ্যা হয়। একদিন মহা-ফ্রেডরিকের সময় ফ্রান্সের ভাষার প্রতি জর্মানির লোলুপতা দেখা গিয়েছিল, কিন্তু সে টিকল না। কেননা ফ্রালের প্রকৃতি থেকে ফ্রান্সের ভাষাকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে তাতে প্ৰাণের কাজ চালানো যায় না। সিংহের চামড়া নিয়ে আসন বা গৃহসজা করতে পারি, কিন্তু সিংহের সঙ্গে চামড়া বদল করতে পারি না । আমাদের স্বীকার করতেই হবে যে, আমরা যেমন মাতৃক্ৰোড়ে জন্মেছি তেমনি মাতৃভাষার ক্রোড়ে আমাদের জন্ম, এই উভয় জননীই আমাদের পক্ষে সজীব ও অপরিহার্য । মাতৃভাষায় আমাদের আপনি ব্যবহারের অতীত আর-একটি বড়ো সার্থকতা আছে। আমার ভাষা যখন আমার নিজের মনোভাবের প্রকৃষ্ট বাহন হয় তখনই অন্য ভাষার মর্মগত ভাবের সঙ্গে আমার